‘চোখের সামনে মরলে মনকে বোঝাতে পারতাম। নিজের সাধ্যমতো বাবার চিকিৎসা করাতাম। বাবার মৃত্যু হলো কারাগারে। বাবার জন্য কিছুই করতে পারিনি।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে মিজানুর রহমানের চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সহসভাপতি গোলাপুর রহমানের (৬৩) ছেলে। রোববার রাত আটটার দিকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে গোলাপুর রহমান গ্রেপ্তার হন। সমাবেশের আগের দিন (২৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই দিন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি ও মোহরা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ আজম, গোলাপুর রহমানসহ সাতজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর পর থেকে তাঁরা গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন।
শনিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কাশিমপুর কারাগারের এক কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে ফোন করে বাবার মৃত্যুর খবর দেন। লাশ আনার জন্য ঢাকায় যেতে বলেন। ওই কর্মকর্তা জানান, বেলা দুইটার দিকে গোলাপুর রহমান অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে কারাগারের ভেতর অসুস্থ হয়ে পড়েন গোলাপুর রহমান। কারা হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাঁকে কারা অ্যাম্বুলেন্সে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে নেওয়ার পর চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার পল্টন থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা ছিল।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ লুৎফর রহমান রোববার বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষে গোলাপুর রহমানের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গোলাপুর রহমানের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় আগে কোনো মামলা ছিল না। রাজনীতির পাশাপাশি ঠিকাদারি করতেন। ডিসেম্বরের পর বাবা–ছেলে পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে কথাও বলেছেন। কিন্তু বাবার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। তাঁর অপরাধ শুধু ঢাকায় সমাবেশে অংশ নিয়েছেন। এই বয়সের ব্যক্তির কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করার শক্তিও নেই গায়ে।
সর্বশেষ ৪ নভেম্বর কাশিমপুর কারাগারে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন মিজানুর। তিনি বলেন, ‘বাবা কারাগারে থাকলেও নিজের জন্য চিন্তা করেননি। শুধু আমাদের কথা চিন্তা করছেন। তিনি শুধু বলেছেন, আমরা যাতে কোনো চিন্তা না করি।’
গোলাপুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রাম নগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় গোলাপুরের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মিথ্যা মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।
গোলাপুর রহমানের স্ত্রী হোসনে বানু বলেন, স্বামীকে এভাবে হারিয়ে ফেলবেন এটা কখনো ভাবেননি। তিনি বলেন, এত বছর সংসার করে মৃত্যুর আগে স্বামীর মুখে একটু পানিও দিতে পারেননি। সামনে থাকতে পারেননি সন্তানেরা। যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাঁদের এই আফসোস থেকে যাবে।
চট্টগ্রাম