‘শারমিন ফোন ধরছে না। ওরা নাকি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। হাসপাতালে নাকি ভর্তি নিচ্ছে না। তুমি একটু যাও তো।’ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কলেজশিক্ষার্থী শারমিনের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন স্বজন ফরিদা বেগম। তিনি রাজশাহী শহরের বাসিন্দা।
ফরিদা বলতে থাকেন, ‘শারমিনের খালু জামালের এই ফোন পেয়েই আমি ৫ মিনিটে হাসপাতালে ছুটে আসি। এসে দেখি লাশের সারি। এর মধ্যে দেখি শারমিনের চাচা আইয়ুব আলীর লাশ। তারপর বুঝতে পারি, শারমিনের দাদার চিকিৎসার জন্য তাঁর সঙ্গে যাঁরা হাসপাতালে আসছিল, তাঁদেরই লাশ এগুলো।’
শারমিনের দাদা ইউনুস আলী (৭৫) ফরিদা বেগমের চাচা। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চরকান্তপুর গ্রামে ইনসাব আলীর বাড়ি। এই দুর্ঘটনায় তিনিও মারা গেছেন। নিহত অন্যরা হলো ইউনুস আলীর মেয়ে পারভীন বেগম (৩৫), ছেলে আইয়ুব আলী ওরফে লাবু (৪০) ও নাতনি শারমিন আক্তার (১৭) এবং অটোরিকশাচালক মোখলেসুর রহমান (৪০)।
আজ শনিবার বেলা তিনটার দিকে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুর এলাকায় ট্রাকের চাপায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা ওই পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আর একজন গুরুতর আহত ব্যক্তিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ফরিদা বেগম জানান, দুই বছর আগে তাঁর চাচা ইউনুস আলীর ক্যানসার ধরা পড়ে। কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনতে হতো। এ জন্য আজ তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হচ্ছিল। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে তাঁরা আসছিলেন। শারমিন রাজশাহী নগরের শাহ মখদুম কলেজে পড়ে। সে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তার কলেজে আসা দরকার। বাড়ি থেকে গাড়ি রাজশাহী আসছিল, তাই সে–ও সঙ্গে আসছিল। আর বাকিরা সবাই চাচার চিকিৎসার জন্য সঙ্গে আসছিলেন।
বিকেল চারটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচটি লাশ সারি করে রাখা হয়েছে। ফরিদা বেগম ছাড়া তাঁদের কোনো স্বজন তখনো এসে পৌঁছায়নি। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে গুরুদাসপুর থেকে পরিবারের লোকজন আসে। তখন সব লাশ কাভারের মধ্যে পুরে ফেলা হয়েছে। তাঁরা চেইন খুলে খুলে মুখ দেখছিলেন। তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাঁরা কাউকে চিনতে পারছিলেন না। ফরিদা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন কোনটা কে।
ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিল শারমিনের হাতের ব্যাগ। তার মধ্যে তাঁর মুঠোফোনও ছিল। একজন পুলিশ সদস্য সেটি উদ্ধার করে হাসপাতালে এনে তাঁদের এক স্বজনকে দিলেন। ব্যাগটি ধরে একজন নারী কেঁদে উঠলেন।
নগরের বেলপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মামুনুর রশিদ জানান, ট্রাকটি টিসিবির মালামাল নিয়ে রাজশাহী থেকে পাবনার সুজানগরে যাচ্ছিল। আর বিপরীত দিক থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি আসছিল। বেলপুকুর মোড়ে এসে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে ট্রাকটি রাস্তার দক্ষিণ পাশের একটি পান-সিগারেটের দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং দোকান ভেঙে রাস্তার পাশের খাদে পড়ে যায়। আর অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, দুর্ঘটনার সময় দোকানের মালিক দেলোয়ার হোসেন দোকানেই ছিলেন। তিনি দোকান থেকে লাফ দিয়ে কোনোরকমে রক্ষা পান।
সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে লাশগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছিল।
বাড়িতে আহাজারি, স্বজনদের ভিড়
বিকেল পাঁচটায় নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার চরকান্তপুর পশ্চিম পাড়ায় ঢুকতেই দলে দলে লোকজনকে একই বাড়িতে যেতে দেখা যায়। বাড়িটি ইউনুস আলীর। বাড়ির চত্বরে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভিড়ে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। সবাই বলাবলি করছিল, কখন নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ বাড়িতে আসবে। ভিড় ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই স্বজনদের আহাজারি শোনা যায়।
নিহত ইউনুস আলীর তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে আবু সাঈদ (৪৮) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা এখন কাদের নিয়ে বাঁচব? আমার একমাত্র মেয়ে শারমিন। সে গত বছর জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেছে। সে রাজশাহী শহরের একটা কলেজে পড়ালেখা করে। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আমার ভাই লাবুর পরিবারে রয়েছে তার স্ত্রী, সাত বছরের ছেলে নাফিউর ও দুই বছরের মেয়ে মাওয়া খাতুন। ওদের আমি কী বুঝ দিব?’
পারভীন বেগমের বিয়ে হয়েছে বড়াইগ্রাম উপজেলার বাসিদেবপুর গ্রামে। তাঁর স্বামী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘শ্বশুরের চিকিৎসার পাশাপাশি আমার স্ত্রী নিজেও চিকিৎসা নিতে যাচ্ছিল। সুস্থ হতে গিয়ে লাশ হলো পারভীন। এখন আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে চলব…।’
শারমিনের মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমরা এখন সবাই স্বজনদের মরদেহের অপেক্ষায় আছি। শুনেছি তাদের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হবে। খবর পেয়ে সব আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসছেন।’