নির্বাচনে অংশ নিলে কোন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও ভোটের দিকেই এগোচ্ছে জাতীয় পার্টি (জাপা)।
দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, সরকার ও বিদেশি বন্ধুদের চাপ উপেক্ষা করে নির্বাচন বর্জন করা সম্ভব নয়। রয়েছে দল ভাঙার ভয়ও। এ জন্য নির্বাচন ভন্ডুল হলে বা সরকার না টিকলে বিপদ হবে জেনেও ভোটে অংশ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতারা বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন বর্জনের পক্ষে। গত মঙ্গলবার জাপার কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের সভায় ৫৯ নেতার দু’জন বাদে সবাই জানান, আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চান না।
নির্বাচনে অংশ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কার কথা বলেছেন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। সভায় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তাগিদ উপেক্ষা করে সরকার সংলাপ ছাড়াই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসা নিশ্চিত।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা এবং জি এম কাদেরের বক্তব্যে জাপার অবস্থান নিয়ে নতুন আলোচনা সৃষ্টি হয়। এরপর গতকাল বুধবার জি এম কাদেরের সঙ্গে সরকারি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেখা করেন। জাপা সূত্র জানিয়েছে, তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বলা হয়েছে। যদিও জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল বলেছেন, নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। কারণ, গত পাঁচ বছরে সরকারের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে, তাতে অভিজ্ঞতা ভালো নয়। দলের নেতারা জি এম কাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে।
জাপা যদিও প্রকাশ্যে বলছে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি, কিন্তু একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, দুই কারণে নির্বাচনে যেতে হবে। প্রথম কারণ, ভারতের ভূমিকা। এক নেতা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপে রাখলেও জাপার পুরোনো বন্ধুদের অবস্থান ভিন্ন। তারা চায় নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে সংবিধান অনুযায়ী হোক।
নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আরেক কারণ দলের ভাঙন ঠেকানো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু রওশন এরশাদকে সামনে রেখে দলের একাংশ বিএনপিবিহীন সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান সমকালকে বলেছেন, তৃণমূলের নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে হলেও দলের ২৩ এমপির অধিকাংশ ভোট বর্জনের বিপক্ষে। জি এম কাদের নেতৃত্বাধীন জাপা নির্বাচন বর্জন করলে দলের বহু নেতা এমপি হওয়ার প্রলোভনে রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভোটে অংশ নেবেন। সরকারের সমর্থন থাকায় রওশনপন্থিদের হাতে দলের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। রওশনপন্থিরা এ সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন।
৪ নভেম্বর জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বাসায় জি এম কাদেরের সভাপতিত্বে কো-চেয়ারম্যানদের বৈঠক হয়। সেখানে অংশ নেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নু আগের মতো এবারের নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকার পক্ষে অনড়। সৈয়দ আবু হোসেন ও সালমা ইসলামও নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। তবে রুহুল আমিন হাওলাদার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। একমাত্র ঢাকা-৬ আসনের এমপি কাজী ফিরোজ রশিদ নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মত দেন।
জাপা সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা-৬ আসন এবার কাজী ফিরোজকে ছাড়বে না আওয়ামী লীগ। ওই আসনে ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী হতে পারেন। আসন হাতছাড়া হওয়ায় ফিরোজ রশিদ নির্বাচনের বিপক্ষে।
ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আওয়ামী লীগকে বার্তা দেওয়া হবে জি এম কাদেরের একক নেতৃত্বে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে। সরকারকে আসন ভাগাভাগিসহ নির্বাচনের সব বিষয় জি এম কাদের শিবিরের সঙ্গে ফয়সালা করতে হবে। রওশন এরশাদ, তাঁর ছেলে রাহগির আল মাহি এরশাদ সাদ বাদে রওশনপন্থিদের আর কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। জাপার একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে না এলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ৫০টি পর্যন্ত আসন বাগিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
তৃণমূলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতার নির্বাচনের বিপক্ষে দেওয়া মতামত এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা নতুন আলোচনা তৈরি করলেও জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, এতে অবস্থান পরিবর্তন হবে না। দলটির জ্যেষ্ঠ তিন নেতার একজন সমকালকে বলেছেন, তৃণমূলের নেতারা আবেগের কথা বলছেন। ভোটের অঙ্কে জাপা ইসলামী আন্দোলনের চেয়ে পিছিয়ে পড়লেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো মনোযোগ পাচ্ছে বিদেশিদের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বড় দুই দলের সঙ্গে জাপাকে চিঠি দিয়েছেন। সংসদে থাকায় জাপা এই গুরুত্ব পাচ্ছে। সংসদের বাইরে চলে গেলে এই গুরুত্ব থাকবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে নাখোশ করবে না জাপা। সংলাপের কথা বলে যাবে।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিতে রাজনৈতিক দলগুলোর শর্তমুক্ত সংলাপ চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল জাতীয় নির্বাচনের তপশিল হয়েছে, এরপরও সংলাপের কথা বলেছে জাপা। জি এম কাদের বুধবার রাতে সমকালকে বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আরও সময় লাগবে। যখনই সিদ্ধান্ত নেব, জানিয়ে দেব।