চৌদ্দ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৮২০ গুণ। এই সময়ে কালো টাকা সাদা করেছেন তিন দফায়। বাড়ি, গাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, রিসোর্টসহ গড়েছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ। যেন হাতে পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ! তিনি সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জান্নাত আরা হেনরী।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ৬ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকার। শিক্ষকতা ও কৃষি থেকে আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার টাকা। বার্ষিক খরচ দেখানো হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা। আয়কর নথির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১৪ বছরে তাঁর সম্পদ ৮২০ গুণ বেড়ে হয়েছে ৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ (সদর ও কামারখন্দ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন হেনরী। নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে তাঁর নামও আসে। কারাগারে থাকা হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের বিরুদ্ধে তাঁর কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের কথা বলেন। এর মধ্যে হেনরীর নাম ছিল। পরে দুদক তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তিন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলেও অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশেষে তাঁকে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর মোট সম্পদ কয়েকশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। নামে-বেনামে এত সম্পদ কোথা থেকে এলো– এ নিয়ে আছে নানা জল্পনা-কল্পনা।
হেনরীর আয়কর নথিতে ২০১৯ সালের ৩০ জুন নিট সম্পদ দেখানো হয় ১১ কোটি ৬৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে জমির দাম হিসাবে ২ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার কালো টাকা সাদা করা হয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত নিট সম্পদ দেখানো হয় ৪৭ কোটি ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকার। এর মধ্যে তিনি ৩২ কোটি ৫০ লাখ কালো টাকা সাদা করেন। ২০২১ সালের ৩০ জুন আয়কর নথিতে নিট সম্পদ উল্লেখ করা হয় ৪৭ কোটি ৭১ লাখ ৮৮ হাজার টাকার। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর নথিতে আবার ১ কোটি ৩০ লাখ কালো টাকা সাদা করা হয়। নিট সম্পদ দেখানো হয় ৫১ কোটি ৯৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকার। হেনরীর স্বামী শামীম তালুকদার লাবুর আয়কর নথিতেও রয়েছে নানা গরমিল। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, তিনি ১ কোটি ৩০ লাখ কালো টাকা সাদা করেছেন।
নামে-বেনামে যত সম্পদ
সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড দেওয়া স্থাবর অনেক সম্পদ আছে। নানা স্থানে একের পর এক গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠান। সিরাজগঞ্জের গজারিয়ায় রিসোর্ট ‘কিছুক্ষণ’, জেলার নলিছাপাড়ায় জান্নাত আরা হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ এবং হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স টেকনোলজি ভবন আছে। সিরাজগঞ্জের স্টেশন রোডে ছয়তলা বাণিজ্যিক ভবন এবং সেটির নিচতলায় মার্কেট করা হয়েছে। অন্য তলাগুলোতে আবাসিক হোটেল ‘আলীশান’। সিরাজগঞ্জ সদরের মুজিব সড়কে ‘রাস মেডিকেয়ার’ নামে ক্লিনিক, জেলার গজারিয়াতে ‘হেনরী ভুবন’ নামে বৃদ্ধাশ্রম, গজারিয়ায় মোতাহার হোসেন তালুকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ গড়া হয়েছে।
তিনি বাস করেন সিরাজগঞ্জের মুজিব সড়কে
অত্যাধুনিক তিনতলা বাড়িতে। এ ছাড়া মুজিব সড়কে একটি বহুতল ভবনে আছে ক্লিনিক। আবাসিক হিসেবেও এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সড়কে আটতলা আরও একটি ভবন আছে তাঁর। এই ভবনটির নিচতলায় মার্কেট করা হয়েছে। জেলার সয়দাবাদের সদানন্দপুরে আছে পাঁচতলা আবাসিক ভবন। এ ছাড়া সয়দাবাদে হেনরীর আলিশান গ্রামের বাড়ি। জেলা সদর পোস্ট অফিসের বিপরীতে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি বহুতল ভবন। গজারিয়ার বাহুকা এলাকায় হেনরী অপটিক ফাইবার লিমিটেড ও সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদের কড্ডায় পেট্রোল পাম্প নির্মাণাধীন। সয়দাবাদের সদানন্দপুরে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন আরেকটি বাণিজ্যিক ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিঞা আয়রন অ্যান্ড স্টিল হাউস রয়েছে।
গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে তাঁর আছে ‘রাস রিসোর্ট’। এই রিসোর্টে ১৪টি আধুনিক কক্ষ, পাঁচটি প্রিমিয়াম বাংলো, আলাদা জায়গায় চারটি আর্কিটেকচারাল ডিলাক্স কটেজ ও আধুনিক সুইমিংপুল রয়েছে। শ্রীপুরে রয়েছে গরুর খামার। চারটি বিলাসবহুল গাড়ি আছে তাঁর।
তবে এ প্রসঙ্গে জান্নাত আরা হেনরী বলেন, ‘আমার যা কিছু সম্পদ আছে, সবই জ্ঞাত আয়ের মধ্যে। বেনামে কোনো সম্পদ নেই।’
জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান আবারও
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চান জান্নাত আরা হেনরী। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। তিনি সিরাজগঞ্জ-২ আসনে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করছেন। এ লক্ষ্যে তিনি জনসংযোগ করছেন। এ ছাড়া এই আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসান, সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ তালুকদার, সিনিয়র সহসভাপতি মেয়র সৈয়দ আবদুর রউফ মুক্তা ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ডা. মাসুদুর রহমান আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।