বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে কাজ করতেন আমার বাবা। বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। স্বাভাবিকভাবেই সৈনিক জীবনের প্রতি আগ্রহ ছিল। খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল। স্কাউটিং করতাম। সাইক্লিং, সাঁতার, দৌড়েও ছিলাম! আর ছিল বই পড়ার নেশা। বোধ হয় ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় হাতে আসে সেবা প্রকাশনীর হেল কমান্ডো। বইটি আমাকে প্রচণ্ডভাবে অনুপ্রাণিত করে। বুকের ওপর কমান্ডোদের সেই ‘সোনালি ডানা’ আমাকে রীতিমতো আবিষ্ট করে। এইচএসসি পাস করে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। ১৯৯৭ সালে কমিশন পাই। এরপর কমান্ডো প্রশিক্ষণ, প্যারাট্রুপার হিসেবে প্রশিক্ষণ—স্বপ্নের পথ ধরে কেবলই এগিয়ে চলা। কিন্তু এরই মধ্যে আচমকা এল সেই দিন—২৯ অক্টোবর ২০০০!
যশোরে প্যারাস্যুট জাম্পের প্রশিক্ষণ চলছে। প্রায় শেষ পর্যায়। সকালে প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ দিলাম। আমার পরপরই আরেকজন জাম্প করলেন। আচমকা কোনাকুনি দমকা বাতাসে তাঁর প্যারাস্যুট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আমারটার সঙ্গে পেঁচিয়ে যায়। ২০০ মিটার ওপর থেকে মাটিতে গিয়ে পড়ি। আমার ওপর তিনি। দ্বিমুখী চাপে প্রচণ্ড আহত হলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাসপাতালের বিছানায় নিজেকে আবিষ্কার করি। জানা গেল, মেরুদণ্ডের তিনটি কশেরুকা (ভার্টিব্রা) ভেঙে গেছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্নায়ুরজ্জু (স্পাইনাল) কর্ড। শরীরের ডান পাশের স্নায়ুগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। দুঃসহ সেই দিনটি আমার গোটা জীবনের গতিপথটাই বদলে দিল।
হুইলচেয়ারের জীবন, ক্রাচের জীবন
হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে দিন কাটছে। হাঁটা তো দূরের কথা, কখনো আর নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারব কি না, তা নিয়েও সংশয়। দিনের পর দিন কেটে যায়, কোনো উন্নতি দেখি না। তিন মাসের মাথায় একদিন প্রথমবারের মতো উঠে বসলাম। মাত্রই কয়েক সেকেন্ড। কিন্তু তাতেই নিজের ভেতর একটা অব্যক্ত তোলপাড় টের পাই। মনে হলো, হ্যাঁ আমি পারব, অবশ্যই পারব।
টানা পাঁচ মাস হাসপাতালে থাকতে হলো। এরপর হুইলচেয়ার, ক্রাচের জীবন। ৯ মাস পর মাটিতে পা ফেলা। এক পা দুই পা করে হাঁটা। দুর্ঘটনার এক বছর পরও ডান পায়ের কর্মক্ষমতা ঠিকমতো ফিরে পাইনি।
মেডিক্যালি আনফিট হয়ে ছেড়ে দিতে হলো স্বপ্নের সেনাজীবন। নিজের সিদ্ধান্তেই ছেড়ে দিলাম। বুঝতে পারছিলাম, শৈশবের যে বিপুল রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে এই পেশা বেছে নিয়েছিলাম, আমার শরীর আর সেসবের পক্ষে নেই। তখনো বয়স কম। বিশ্বাস ছিল, নতুন কোনো পেশা বেছে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারব।
২০০২ সালে এমবিএ ভর্তি হলাম। পাশাপাশি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দিলাম। ২০০৫ সালে একটা আইটি কোম্পানিতে যোগ দিলাম। একই বছরে বিয়েও করলাম।
নতুন স্বপ্নের পথে
২০০৯ সালের এক বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বাসার পার্শ্ববর্তী পার্কে হাঁটছি। হুট করেই মনে হলো, একটু দৌড়ে দেখা যাক না! যদিও দৌড়ঝাঁপ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন ডাক্তার। প্রথমে ধীরে, পরে হালকা গতি বাড়িয়ে মোটামুটি ১০০ মিটারের মতো দৌড়ালাম। ডান পা ঠিকমতো পড়ে না, পুরো জোরও পাই না। দুই পায়ের ভারসাম্যও ছিল না। ফলে দৌড়াতে বেশ কষ্ট হলো। তারপরও দৌড়াতে পারার আনন্দে আমি উচ্ছ্বসিত। ধীরে ধীরে দৌড়ের গতি ও দূরত্ব বাড়াতে থাকি। প্রথম প্রথম খুব সমস্যা হতো। শরীরে, পায়ে ব্যথা হতো। একপর্যায়ে লক্ষ করলাম, এসব শারীরিক প্রতিকূলতাও মানিয়ে নিতে পারছি। ২০১০ সালে এসে শুরু করলাম সাইকেল চালানো। আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। ২০১৩-১৪ সালের দিকে প্রথম হাফ ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিলাম। ২১ কিলোমিটার দৌড়ালাম। এরপর বিভিন্ন সাইক্লিং রেসেও অংশ নিতে শুরু করলাম।
তত দিনে নতুন জীবনের আনন্দ আমি পেয়ে গেছি। সব সময় এমন জীবনই আমি চেয়েছি, যে জীবনে শারীরিক ও মানসিক দুই দিক থেকেই সুস্থ থাকা যায়, আনন্দে থাকা যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৭ সালে ঢাকা চ্যালেঞ্জ ট্রায়াথলনে প্রথম অংশগ্রহণ করি। প্রথমে সাঁতার, এরপর সাইক্লিং, সব শেষে দৌড়—ট্রায়াথলনের তিনটি বিভাগই আমি খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করি। এর আগে শ্রীলঙ্কায় একটি সাইক্লিংয়ে অংশ নিই। সেখানে তিন দিনে ৩৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালানোর পর আমার মনোবল ও সাহস দারুণভাবে বেড়ে যায়। ঢাকা চ্যালেঞ্জের পর ২০১৮ সালে প্রথম দেশের বাইরে ট্রায়াথলনে অংশ নিই, ব্যাংকক ট্রায়াথলন। একই বছরের নভেম্বরে মালয়েশিয়াতে আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি।
আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা দীর্ঘ দূরত্বের ট্রায়াথলন। এখানে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার, ১৮০ কিলোমিটার সাইকেল এবং ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড়াতে হয়। সময় বরাদ্দ থাকে ১৭ ঘণ্টা। আমার লাগল ১৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিটের মতো। প্রতিযোগিতাটা হচ্ছিল মালয়েশিয়ার লাংকাউইতে। প্রচণ্ড গরম, তীব্র আর্দ্রতা, মাঝেমধ্যে ঝড়বৃষ্টি—সে এক ভয়ংকর প্রতিকূল আবহাওয়া। এই প্রতিযোগিতা সম্পন্ন করতে পারাটা আমার জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জরই ছিল।
২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার অর্ধদূরত্বের আয়রনম্যান ৭০.৩ রেসে অংশ নিই। এরপর কোভিডের জন্য ২০২০-২১ সাল তো ঘরেই কেটে গেল। অবশ্য ২০২১ সালের শেষের দিকে সাঁতার কেটে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিই। ২০২০ সালে মালয়েশিয়া আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার জন্য নিবন্ধন করেছিলাম। সেটিই পেছাতে পেছাতে ২০২২ সালে এসে অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয়বারের মতো তাতে অংশগ্রহণ করি। এবার সময় লাগে ১৪ ঘণ্টা ২৩ মিনিট। চলতি বছর দুটো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। মে মাসে বাংলাদেশের আরেক আয়রনম্যান শামসুজ্জামান আরাফাতের সঙ্গে হিমালয়ান এক্স-ট্রাইয়ে অংশ নিই। লম্বা দূরত্বের ট্রায়াথলনের কঠিনতম পর্ব আয়রনম্যান। আর লম্বা দূরত্বের ট্রায়াথলনের প্রতিযোগিতার এক্সট্রিম বা চরম পর্ব হচ্ছে এই এক্স-ট্রাই। সর্বশেষ চলতি মাসে মালয়েশিয়ার লাংকাউইতে তৃতীয় আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা সম্পন্ন করেছি।
শরীরের নাম মহাশয়
শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাবে তাহাই সয়—এই পুরোনো প্রবাদটি আমার কাছে মনে হয় খুবই সত্যি। যথাযথ প্রশিক্ষণ আর মনের তীব্র জোর থাকলে যেকোনো বিরূপ পরিস্থিতিই মোকাবিলা করা সম্ভব। আমার আত্মীয়স্বজনেরা তো বটেই, চিকিৎসকেরাও কখনো ভাবতে পারেননি, আমি আবার স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে, দৌড়াতে পারব। কিন্তু আমি পেরেছি এবং দারুণভাবেই পেরেছি। এখন আমার বয়স ৪৮ বছর। আছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও। কিন্তু বয়সের অঙ্ক, শরীরের প্রতিবন্ধকতা—এই সবকিছুকেই পেছনে ফেলতে পেরেছি মনে হয় একটি কারণে, সেটা হলো মনের জোর।