সদস্যদেশগুলোর চাঁদার পরিমাণ বাড়লে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেওয়া সক্ষমতা আগামী এক দশকে ১৫০ বিলিয়ন বা ১৫ হাজার কোটি ডলার বাড়তে পারে। তবে এর চেয়ে বড় বিষয় হলো, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংকের পরিসর বা আওতা বাড়াতে হবে।
মরক্কোর মারাকেশে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ–আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক বৈঠক হচ্ছে। সেই বৈঠক উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বুধবার এসব কথা বলেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা। এবার বার্ষিক বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সংস্কার, যাতে তারা জলবায়ু পরিবর্তন, ঋণ ও দারিদ্র্যের মতো বিষয় আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে অজয় বাঙ্গা আরও বলেন, দারিদ্র্য, মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো ঝড়ের মতো, যেগুলো এখন আর পৃথকভাবে মোকাবিলা করা যাবে না। এসব চ্যালেঞ্জ কেবল অর্থ দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না; বরং সে জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। তিনি বলেন, ‘সন্দেহ নেই, আমাদের আরও বড় ব্যাংক দরকার, তবে শুধু অর্থ–ব্যাংক নয়, আমাদের জ্ঞান-ব্যাংক দরকার।’
গ্লোবাল অ্যাকশন, গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট বা বৈশ্বিক উদ্যোগ, বৈশ্বিক প্রভাব—এই হলো বিশ্বব্যাংক গ্রুপ-আইএমএফের এবারের বার্ষিক বৈঠকের প্রতিপাদ্য। এবারের বৈঠকে আরও যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে, সেগুলো হলো জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন; অর্থাৎ কীভাবে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক রূপান্তরে অর্থায়ন করা যায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা গড়ে তোলা যায়।
এ ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করা; মানুষের জীবনের মান ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়ানো; নারী ও শিশুদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে নারী-পুরুষের ব্যবধান হ্রাস; বেসরকারি খাতের উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা ও কর্মসংস্থান তৈরি; উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক স্থিতিশীলতা ও ঋণ ব্যবস্থাপনা করা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অজয় বাঙ্গা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণসংকট নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, অনেক দেশেই ঋণের বোঝা বাড়ছে। সে কারণে এসব দেশের পক্ষে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে না। অনেক দেশের ঋণ সীমার বাইরে চলে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের নতুন এই প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ যে পর্যায়ে চলে গেছে, তাতে এখন বিদ্যমান কাঠামোর বাইরে গিয়ে কাজ করার সময় হয়েছে কি না। জবাবে অজয় বাঙ্গা বলেন, ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার কারণে যে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। বিকল্প কাঠামো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যমান কাঠামোতে যে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, জাম্বিয়া ঋণসংকট থেকে বেরিয়ে এসেছে, ঘানার বেলায়ও অগ্রগতি হচ্ছে।
তবে ঋণের গঠনে পরিবর্তন এসেছে বলে জানান অজয় বাঙ্গা। তাঁর মতে, আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে যেমন ছিল, এখনকার বাস্তবতা তেমন নয়। তখন প্যারিস ক্লাবের সদস্যদেশগুলো সবচেয়ে বড় দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা ছিল, কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এখন বাণিজ্যিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোও আছে। তিনি বলেন, ঋণসংকট মোকাবিলায় সব পক্ষকে আলোচনার টেবিল নিয়ে আসতে হবে। তবে কিছু কিছু ঋণের ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা আছে।
তবে ঠিক কী পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা অনেক সময় গোপনীয়তার চাদরে মোড়ানো থাকে—এই সংখ্যা জানা না গেলে নতুন কাঠামোও করা যাবে না বলে মত দেন তিনি। প্রকৃত সংখ্যা জানা গেলেই কেবল ঋণ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তাঁর বিশ্বাস, প্রকৃত সংখ্যা বের করে আলোচনার টেবিলে বসলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
বিশ্বব্যাংক প্রধান বলেন, চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে জাম্বিয়াকে কেবল অনুদান দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, ঋণ নয়। এ ছাড়া সমজাতীয় আরও কিছু দেশ যেমন চাদ, ইথিওপিয়া, ঘানার ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই চারটি দেশে বিশ্বব্যাংক গত তিন বছরে ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি সহায়তা দিয়েছে, যার বড় অংশই অনুদান।
ঋণের কাঠামো সম্পর্কে অজয় বাঙ্গা জানান, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সার্বভৌম ঋণ নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা করেছে। সেখানে ঋণের বিদ্যমান কাঠামোর বাইরে যাওয়া নিয়েও আলোচনা হয়েছে। লক্ষ্য হচ্ছে, প্যারিস ক্লাব, অন্যান্য ঋণদাতা দেশ ও বেসরকারি ঋণদাতাদের এক টেবিলে নিয়ে আসা। জাম্বিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশে ঋণ পরিস্থিতির যে উন্নতি হয়েছে, তা এই গোলটেবিল আলোচনার ফল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ ছাড়া নতুন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাংকে চীনের ভূমিকা বাড়বে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অজয় বাঙ্গা বলেন, চীন বিশ্বব্যাংকের খুবই গঠনমূলক অংশীদার। চীন কীভাবে উন্নয়ন করেছে, সেই জ্ঞান বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে অন্যান্য দেশে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চীনের ভূমিকাও পরিবর্তিত হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া এখন আর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নেয় না, তারা এখন শুধুই চাঁদা দেয়। চীনেরও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা অনেক দিন ধরেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠান এখনো প্রতিষ্ঠাকালীন বাস্তবতার আলোকে পরিচালিত হচ্ছে। চলমান বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাতে হলে নতুন শক্তিগুলোর ভূমিকা বাড়াতে হবে।
প্রায় ৫০ বছর পরে আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক বৈঠক হচ্ছে। ৯ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই বার্ষিক বৈঠক ১৫ অক্টোবর শেষ হবে।