চীনে তরুণেরা চাকরি ছেড়ে ‘পদত্যাগ পার্টি’ উদ্‌যাপন করছেন কেন

0
155
গত মে মাসে চাকরি ছেড়ে বন্ধুদের নিয়ে ‘পদত্যাগ পার্টির’ এ আয়োজন করেন চীনের একটি ব্যাংকে জনসংযোগ বিভাগের সাবেক কর্মী লিয়াং।

চীনে তরুণেরা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘটা করে ‘পদত্যাগ পার্টির’ আয়োজন করছেন তাঁরা। দেশটিতে তরুণ বেকারত্বের উচ্চহার থাকা সত্ত্বেও এ চাকরি ছাড়ার ঘটনায় দেশটিতে উদ্বেগ বাড়ছে। এ প্রবণতা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীনের ঝেজিয়াং প্রদেশের লিয়াং (ছদ্মনাম) যেদিন ব্যাংকের চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, সেদিন তাঁর বন্ধুরা পার্টির আয়োজন করে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ওই পার্টিতে ঐতিহ্যবাহী বিয়ের আচারের মতো ঢোল বাজানো হয়েছিল। এর আগে লিয়াংয়ের বন্ধুরাও চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন।

চীনে তরুণদের বেকারত্বের হার এখন রেকর্ডসংখ্যক। এরপরও ঈর্ষা করার মতো উচ্চ বেতনের স্থিতিশীল চাকরি ছেড়ে তা এভাবে উদ্‌যাপন করা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। তবে ২৭ বছর বয়সী লিয়াং চাকরি ছেড়ে একটি ক্যাফে চালানোর পাশাপাশি এখন একজন নির্মাতা হয়ে উঠেছেন। তিনি মূলত কনটেন্ট ক্রিয়েটর।

চীনের একটি ব্যাংকে জনসংযোগ বিভাগের সাবেক কর্মী লিয়াং বলেন, গত মে মাসে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে তিনি আরও সুখী হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যন্ত্রের মতো একই কাজ করে যাচ্ছিলাম। এতে আমার অনেক শক্তি খরচ হতো। প্রতিষ্ঠানে এক সময় আপনার সৃজনশীল ধারণাগুলো খারিজ হয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত আপনিও অদৃশ্য হয়ে যাবেন।’

চলতি বছর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তা উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানের শতাধিক পোস্ট চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটি ধীরে ধীরে করোনা পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বর্তমানে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে। চাকরি ছেড়ে দেওয়া অধিকাংশেরই বয়স ২০ বছরের কম। তাঁদের চাকরি ছাড়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে কম মজুরিও একটি কারণ হিসেবে বলা হয়েছে।

পেশাজীবীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনের মতো চীনের মাইমাইয়ের তথ্য অনুসারে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এক জরিপে অংশ নেওয়া বিভিন্ন সেক্টরের ১ হাজার ৫৫৪ কর্মচারীর মধ্যে ২৮ শতাংশ সেই বছরই পদত্যাগ করেছেন। যাঁরা পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এখনো করেননি, তাঁদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ নামে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তা উদ্‌যাপনের মতো একই ধরনের একটি বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত দুই বছরে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ ঘটনা আগে শুরু হলেও চীনে তা সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

চীনে চাকরি ছেড়ে দেওয়া অধিকাংশেরই বয়স ২০ বছরের কম। ফাইল ছবি: রয়টার্স

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রবণতা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। কারণ, দ্রুত ক্রমহ্রাসমান জন্মহার ও সংকুচিত কর্মশক্তি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, চীনা তরুণ প্রজন্মের জন্য সমস্যা তৈরি করবে।

অসুস্থ প্রতিযোগিতা হতাশ করছে

চীনের অনেক শিশুই অল্প বয়সে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা শুরু করে দেয়। বছরের পর বছর স্কুল-পরবর্তী টিউশন আর কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা (গাওকাও) ভয়ংকর চাপের হওয়ায় এ প্রতিযোগিতায় শামিল হয় প্রায় সবাই।

নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অর্থনীতির অধ্যাপক ন্যান্সি কিয়ান বলেছেন, ‘আমার ধারণা, পশ্চিমা ও চীনের বাইরের মানুষ বুঝতে পারে না যে [সেখানে] শিশু হওয়া কতটা কঠিন। তরুণেরা হতাশাকে সঙ্গে নিয়ে এ বিষয়গুলো মোকাবিলা করছে। কঠোর পরিশ্রম করার কারণে এসব বিষয় নিয়ে তাদের ক্লান্তি ও বিরক্তি আছে।’

অনেকেই এমন এক সময়ে বেড়ে উঠেছেন, যখন চীনের অর্থনীতি পূর্ণ গতিতে চলছিল এবং ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক বলে মনে করা হয়েছিল। ক্রমহ্রাসমান জন্মহারের কারণে চীন এক সন্তান নীতি থেকে সরে এসে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শর্ত শিথিল করেছে। এ পরিস্থিতিতে মা-বাবাদের উচ্চ প্রত্যাশার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

ন্যান্সি কিয়ান বলেন, তাঁদের বলা হয়েছিল, তাঁরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলে সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে তাঁরা একটি মন্থর অর্থনীতি ও অতিরিক্ত কাজের সংস্কৃতির মুখে পড়েছেন। এ কারণে উচ্চ বেকারত্বের হার ও স্থবির বেতনের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। তিনি আরও বলেন, ‘এতে তাঁদের নৈতিকতা ও কাজের নৈতিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে, যা তাঁদের সারা জীবন ধরে শেখানো হয়েছে। তাঁরা সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে গেছেন।’ মূলত তরুণদের আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন, যা চাকরি তাঁদের দিতে পারছে না।

শিক্ষা ও চাকরির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও তাঁদের দক্ষতা এবং উপলভ্য চাকরির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। এ কারণে চাকরির প্রতি তাঁদের আগের মোহভঙ্গ হচ্ছে।

চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাভুক্তির মাত্র ১০ বছরে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২০২১ সালে ৫৭ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে।

শিক্ষাগত যোগ্যতা, দক্ষতা ও চাকরির মধ্যে বিস্তর ফারাকের চাকরির প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স

যা–ই হোক, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়াও লু তাঁর গবেষণায় দেখেছেন, কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যকের চাকরির জন্য অতিরিক্ত যোগ্যতা আছে। এর অর্থ এ অবস্থানের জন্য তাঁরা স্কুলে যে দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করেছেন, তার প্রয়োজন পড়ছে না।

অধ্যাপক ইয়াও লু বলেন, ‘তাঁরা যে চাকরি করছেন, তা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল হতে পারে, ভালো বেতন দিতে পারে। যেমন স্থানীয় জেলা অফিসে প্রশাসনিক পদ ও খাবার সরবরাহকারীর চাকরি। তবে এসব এমন চাকরি, যার জন্য সাধারণত কলেজ ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না।’

ইয়াও লু আরও বলেন, শিক্ষা ও চাকরির এই বিস্তর ফারাকের গুরুতর সামাজিক পরিণতি আছে। এর মধ্যে জীবনযাত্রা ও চাকরি নিয়ে কর্মীরা প্রায়ই সন্তুষ্টির নিম্ন স্তরের থাকেন।

চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ফোশানের বাসিন্দা ভেরন মাই। তিনি সংগীতে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে নিজের চাকরি নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। বাধ্য হয়ে তিনি দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজের দিকে মনোনিবেশ করেন। একটি রেস্তোরাঁর কর্মী হওয়ার আগে তিনি গাড়ি ধোয়ার কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ‘গ্রেট রেজিগনেশন’ নামে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তা উদ্‌যাপনের মতো একই ধরনের একটি বিষয় আছে। যুক্তরাষ্ট্রে গত দুই বছরে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এ ঘটনা আগে শুরু হলেও চীনে তা সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে।

গ্রীষ্মকালে তীব্র গরমের মধ্যে ভেরন মাইকে কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, ‘গরমের কারণে যদি গ্লাভস পরেন, সেটিও হাতের জন্য ক্ষতিকর। হাত কুৎসিত হয়ে যায়। সেখানে আমি এক মাস কাজ করার পর অন্যদের হাত দেখাতে লজ্জা পেয়েছিলাম। তাহলে আমি নিজেকে কীভাবে একজন সংগীতের ছাত্র বলতে পারি?’ তিনি আরও বলেন, ওই কাজে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ‘কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা’ ছিল। উচ্চশিক্ষার ডিগ্রির প্রসার সত্ত্বেও চীনের অর্থনীতিতে বর্তমানে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর প্রয়োজন নেই এবং অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করতে অনেক সময় লাগে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

শ্রমবাজারে কর্মী কমছে

শ্রমবাজারে ভারসাম্যহীনতা একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এটি অর্থনীতির জন্য ভালো কোনো খবর নয়। কারণ, এ ভারসাম্যহীনতা নানা কাজে একাধিক বাধার সৃষ্টি করে।
কয়েক বছর ধরে চীনের প্রজননহার কমছে। এর অর্থ দেশটিতে শিশু এবং চাকরি করবেন, এমন প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ কারণে ইতিমধ্যে দেশের বয়স্ক জনসংখ্যাও দ্রুত বার্ধক্যে চলে যাচ্ছেন। এতে পেনশন তহবিল, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য কল্যাণ পরিষেবার চাহিদা বাড়ছে।

অধ্যাপক ন্যান্সি কিয়ান বলেছেন, এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে খারাপ দিক হলো যদি হতাশ তরুণ-যুবকেরা স্থায়ীভাবে শ্রমশক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে আগামী বছরগুলোতে বয়স্কদের সমর্থন করার জন্য কর্মীও অনেক কমে যাবে। চাকরি থেকে চলমান পদত্যাগের প্রবণতা জন্মহারকেও প্রভাবিত করতে পারে। তবে কীভাবে তা প্রভাবিত করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন তিনি।

অর্থনীতির এই অধ্যাপক আরও বলেন, চাকরি ছেড়ে দেওয়া তরুণদের সম্পর্ক ও পরিবার শুরু করতে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। অথবা তাঁরা ‘আয় হারানো ও হতাশাগ্রস্ত আবেগের’ কারণে এই প্রক্রিয়াকে আরও বিলম্বিত করতে পারেন। এটা উদ্বেগের বিষয়।

তবে যাঁরা চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, তাঁরা শ্রমশক্তি থেকে একেবারে বেরিয়ে যাচ্ছেন না। অনেকেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। এতে জানা গেছে, চাকরি ছেড়ে তাঁরা অন্য কোনো শিল্পে বা ভিন্ন কোনো কাজে যোগ দিয়েছেন। আর এই প্রবণতা ঠিক কত দিন চলবে, তা এখনো স্পষ্টভাবে জানা যায়নি।

লিয়াং বর্তমানে পাহাড় ও উপকূলঘেরা পূর্বাঞ্চলীয় শহর তাইঝোতে একটি ক্যাফে চালান। তিনি বলেছেন, ‘যখন চাইব, তখনই এ কাজ ছেড়ে দিতে পারি। তবে এতে হয়তো এক বা দুই বছর পর হতাশ হয়ে আবার আমাকে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.