আধুনিকতা মানবিকতা

0
206
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আমি আশাবাদী মানুষ। আমি অনেকবার ভেবেছি- একটা সামান্য কেরানির চাকরি পাবার জন্যও তো জীবনের অন্তত ১৪টি বছর একজন মানুষকে পড়াশোনা করতে হয়; বিএ পাস করতে হয় (আজকাল আবার বিএ পাসেও হয় না, এমএ লাগে)। পাস করার পর শুরু হয় আবেদনপত্র পাঠানোর দুর্দৈব এক দুই তিন, শত শত, হাজার হাজার। তারপর শুরু হয় ইন্টারভিউ। কিন্তু এতেও হয় না। এরপরে চলে খালু, মামা, চাচা, ফুপা, মিনিস্টার, ব্যারিস্টারের ধরাধরি। কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে, দিন-দুনিয়া ওলটপালট করে তবে না একটা চাকরি!

কিন্তু এই যে দুর্লভ মানবজীবন, এই যে অনিন্দ্য, অপরিমেয়, অপার্থিব জীবনটা- কত সহজে একে আমরা পেয়ে গেছি, পুরো নিখরচায়। কোনো পড়াশোনা লাগেনি, কষ্ট-সাধনা না, কোনো আবেদনপত্র, কোনো সাক্ষাৎকার, কোনো মামা, চাচা, খালু, ফুফা নেই, যোগ্যতাও লাগেনি কোনো, অথচ এই অপার্থিব, বিস্ময়ভরা জীবনটা এসে গেল হাতের মুঠোয়। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, যদি গারো পাহাড়ের মতো বিশাল একটা রাজভোগ থাকত কোথাও, রসে-মাধুর্যে অপর্যাপ্ত, আর সেখানে একটা পিঁপড়াকে ছেড়ে দিয়ে বলা হতো :’খা, নাক মুখ গুঁজে, প্রাণ ভরে যত পারিস খা’, তাহলে ব্যাপারটা তার জন্যে যা হতো এই অন্তহীন, সূর্য-তারা-ভরা, সৌন্দর্যে মাধুর্যে উপচানো পৃথিবীতে এসে পড়া আমাদের জন্যও তো তাই। এমন অপরিমেয় একটা জীবন পাওয়ার পর আজ কী করে আমি বলব ‘জীবনে কিছু পাইনি’! এর পরেও আমি কি আশাবাদী না হয়ে পারি? পৃথিবীর প্রতিটি রস আর মাধুর্য কণাকে আহরণ করতেই তো আমি কৃতার্থ হয়ে রয়েছি। কী পাইনি, সেটার দিকে তাকানোর সময় কোথায়? এমন ছোট্ট দু’দণ্ডের একটা একমুষ্টি এই জীবন, তা নিয়েও আবার নৈরাশ্য। কোনো মানে হয় এর? সবাই জানেন, আমাদের দেশে এখন বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট চলছে। আমি মনে করি, সংকটটা শুধু রাজনীতির নয়, গোটা জাতীয় জীবনের। রাজনীতির দিকে তাকালে ব্যাপারটাকে একটু স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে, এই যা। আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের সংকটও ওই সংকটটারই শাখা। নগরে আগুন লাগলে মসজিদ-মন্দিরও রেহাই পায় না। আমাদের জাতির বর্তমানের এই ব্যাপক সংকটের হাত থেকে সংস্কৃতির কমনীয় জগৎও রেহাই পায়নি। তার সোনালি চুলেও আগুন লেগেছে।

আমার ধারণা, আমাদের এই সংকটের মূল কারণ সুষ্ঠু রাষ্ট্র কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং এর ফলে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে আমাদের বিত্ত-বৈভবের দানবীয় বিকাশ।
অতীতে আমাদের দেশে কখনও বিত্তের বিকাশ হয়েছিল- এমন কথা আমার জানা নেই। কথায় আছে, ‘গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছের’ এক সোনার বাংলা ছিল এক সময়, কিন্তু সে হয়তো হিন্দুশাস্ত্রের সত্যযুগের মতোই এক অলীক স্বপ্নকল্পনা। আমার ধারণা, আমাদের জাতি গত ৩০০০ বছরে যে বিত্ত-বৈভব অর্জন করতে পারেনি, গত ৩০ বছরে তার চেয়ে অনেক বেশি সংগ্রহ করেছে। এটা হয়েছে স্বাধীনতার কারণে এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাবে। হঠাৎ করেই কোটি কোটি সুযোগের দরজা খুলে গেছে আমাদের সামনে, সমগ্র জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। লুণ্ঠন আর দস্যুতা দিয়ে গড়ে তুলেছে জাতির প্রথম পুঁজি। অনৈতিক ও নির্বিবেক এই জাতীয় দস্যুবৃত্তিকে সমর্থন জানানোর কোনো অবকাশ নেই, কিন্তু আমাদের সমাজে বিত্তের প্রথম আগমন ঘটেছিল এভাবেই। এটাই ইতিহাস। বহু শতাব্দী ধরে এই জাতি একটা আধ্যাত্মিক জগতে বাস করেছে। বৈষয়িক বা বস্তুগত জীবন আমাদের ছিল দুর্বল। অতীতে আমরা সব সময় বিত্তকে উপহাস করেছি, দারিদ্র্যকে গৌরবান্বিত করেছি। আজ প্রায় বিনা নোটিশে ওই বস্তুজগৎ এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের দরজায়। তাই নদীর প্রথম বর্ষার হিংস্র উচ্ছ্রিত জলস্রোতের মতোই এ এমন ক্লেদাক্ত ও আবিল। আমাদের এতদিনের মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়েই একে আমাদের পেতে হয়েছে। এই সর্বগ্রাসী বৈষয়িক লালসার সামনে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া আমাদের আর সব কিছুই মুছে গেছে। সেটা আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য- সবখানেই।

 

 

আমাদের রাজনীতিতে প্রধান দুটো দলের মধ্যে আজ বিরোধ তুঙ্গে। কিন্তু বলুন, এই বৈরিতা কতখানি মতবাদের দ্বন্দ্ব আর কতখানি স্বার্থের? আদর্শের নাম করে ব্যক্তিগত স্বার্থ সন্ধান। কেন দু’দলের মধ্যে কথা নেই? এটা যদি মতাদর্শের বিষয় হতো, দেশপ্রেম বা জনকল্যাণের কথা হতো, তাহলে দু’দল ওইসব বিষয় নিয়ে একই জায়গায় বসত। সমস্যা সমাধান করত। কিন্তু এই রাজনীতিতে জনকল্যাণ নেই, দেশবাসী নেই, লোকহিত নেই, আছে শুধু আমি ও আমার স্বার্থ। সুতরাং আমরা সবাই কোনো-না-কোনো দলে। নিরীহ জনসাধারণও দুটি দলের একটিকে বেছে নিয়েছে তার আড়ালে অন্য দলের আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য (যদিও তারা জানে না, যতই তারা বাঁচতে চেষ্টা করুক আসলে তারা দু’দলের দুর্বৃত্তদেরই শিকার)।

তো, এই নির্বিবেক স্বার্থের সামনে মূল্যবোধ দাঁড়াবে কোথায়? যার ভেতর মূল্যবোধ আছে সে আজ এই সমাজের সবচেয়ে পরিত্যক্ত ও করুণাবহ মানুষ। যারা মূল্যবোধকে যত পরিহার করেছে তারাই এই সমাজে তত বড়। যে পুরোপুরি পরিহার করেছে, এ দেশ তার সন্তানদের পৈতৃক সম্পত্তি। এই অবারিত স্বার্থলিপ্সার সামনে সব মূল্যবোধের পতন হয়েছে। এ পতন হয়েছে সব জায়গায়, যদিও আগেই বলেছি, এই মূল্যবোধের পতনের মধ্য দিয়ে জাতির অর্থনৈতিক শিরদাঁড়া তৈরি হয়েছে। তাই এই বিত্তের বিকাশের একটা ইতিবাচক দিকও আছে। এই বিকাশ আমাদের জাতীয় পুঁজি তৈরি হতে সাহায্য করেছে। আবার একই সঙ্গে এ আমাদের উদ্ধারহীন এক গভীর অন্ধকূপে নিক্ষেপ করেছে। মূল্যবোধ, আদর্শ ও ন্যায়বিচারের জায়গায় আমাদের পুরো নিঃস্ব আর দেউলিয়া করে ফেলেছে।

আজ আমাদের জাতির প্রধান দুঃখ এ নয় যে, আমরা বেশিরকম আর্থিক দুঃখে আছি, আমাদের দুঃখ, আমরা সুবিচার পাচ্ছি না; নৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছি, প্রতি পদে লুণ্ঠিত হচ্ছি। একটা জাতির প্রতিটি মানুষ নিজের নিজের উন্নতি করে চললে এক সময় দেখা যায় তা জাতীয় উন্নতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব উন্নতি এক সময় সামগ্রিক উন্নতিতে রূপ নেয়। সমাজকল্যাণের ভেতরেও তাই। আজ জাতির মধ্যে অস্ম্ফুটভাবে একটা সামগ্রিক উন্নতির চেতনা জেগেছে। আমার ধারণা, এই সমবেত চিন্তার মুখে আজকের এই নির্লজ্জ ব্যক্তিস্বার্থ একটু একটু করে প্রতিহত হবে। জাতিই তা প্রতিহত করবে। সে প্রতিরোধের সূচনা অস্ম্ফুটভাবে দেখতেও পাচ্ছি। আমাদের আশার সৃষ্টি হয়েছে অন্য একটা জায়গায়।

একটা উনিশ-শতকী কথা আছে :প্রথম প্রজন্মের মানুষ শুধু (সম্পদ) কিনে চলে, রাক্ষসের মতো শুধু দখল করে, শাদা বাংলায় বলতে গেলে (যা এখন আমাদের দেশে চলছে) : পায়ের তলায় মাটি পাবার জন্য পাগলের মতো হুড়োহুড়ি করে। তাই তাদের মজা করে বলা হয় ‘কেনারাম’। দ্বিতীয় প্রজন্ম এসে দেখে, অলৌকিক জাদুবলে, বিনাশ্রমে, বিনাচেষ্টায় এক বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়ে বসে আছে তারা। বাবারা কেন গোটা পৃথিবীটাকে এমন দানবের মতো উদরস্থ করেছিল, তাদের কী সমস্যা ছিল তারা তা বুঝতে পারে না। তাদের কাছে বাবাদের অসংস্কৃত, জন্তুসুলভ বর্বর মানুষ বলে মনে হয়। বাবাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির ওপর বসে শুরু হয় তাদের নিশ্চিন্ত বাবুগিরি। তাই এই দ্বিতীয় প্রজন্মকে বলে ‘বাবুরাম’। এরা হয়ে ওঠে রাজবংশের লোক। এদের প্রায় সবাই বাবাদের জন্তুপ্রকৃতি পেলেও ১০ ভাগ পায় দেবতাপ্রকৃতি। এই ১০ ভাগ আত্মোৎসর্গ করে। তারা বাবাদের শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি ও সামাজিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে কাজ করে বলে তাদের আত্মোৎসর্গ হয় প্রথম প্রজন্মের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তৃতীয় প্রজন্মের নাম ‘বেচারাম’। এরা বৈষয়িক সংগ্রহে আগ্রহহীন, উচ্চতর ও সূক্ষ্ণতর চেতনার মানুষ। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া ধনসম্পদ বিক্রি করে শ্রেয়তর কাজে অমৃতের স্বাদ আহরণ করতে চায়। ওই সময়টাই মানবিক অবদানের সর্বোচ্চ সময়। এরা সম্পদ চায় না, চায় আত্মার চরিতার্থতা (কিন্তু মনে রাখতে হবে, সবাই এমন করে না, করে ওই ১০ ভাগ কি তারও কম মানুষ। মানুষের একদিকের ১০ ভাগ যেমন দুরারোগ্য দেবতা তেমনি অন্যদিকের ১০ ভাগ দুরারোগ্য জন্তু)। নিরঙ্কুশ আত্মোৎসর্গ থাকে বলে এদের অবদান হয় গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে আজ কেনারামদের যুগ চলছে। কিন্তু দ্রুতই আমরা বাবুরামদের প্রজন্মে চলে যাব। এর সূচনা শুরু হয়েছে। আমাদের প্রজন্ম লুটতরাজ করে যে সম্পদ জোগাড় করেছে, তার ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে আমাদের সন্তানরা আসছে। আমাদের মতো তাদের ততটা আর্থিক কষ্ট করতে হচ্ছে না। তাদের হাতে থাকছে উদ্বৃত্ত সময় পৃথিবীকে ভালোবাসার, চারপাশের দুঃখে বেদনায় ব্যথিত হবার অবসর। আশা করা যায়, সেই দুঃখের উত্তর দিতে তারা উদ্বুদ্ধ হবে। সমাজে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার সেই সৈনিকদের এক দুই করে এগিয়ে আসতেও দেখছি। আমি শিক্ষক, আমি এই বাবুরামদের পড়াই। তাদের এগিয়ে আসা আমার চোখে পড়ে।

আমি অনেক সময়ই রসিকতা করে আমার ছাত্রদের বলেছি, বাপ কি চুরি-টুরি করে? ঘুষটুষ খায়? খুন করেছে দু-চারটা? জাতীয় দস্যুতা, রাষ্ট্রীয় দস্যুতা- করেছে এসব? যদি করে থাকে তাহলে আমি তোমাকে পড়াতে রাজি। কারণ তিনি ওই কাজটি করে তোমার একটা বিরাট সুবিধা করে দিয়ে গেছেন। তা হলো :তোমাকে আরেকবার ওই কাজটি করার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি যদি ওসব না করে গিয়ে থাকেন তাহলে তুমিই তো সেই চোর, সেই ঘুষখোর, সেই খুনি বা রাষ্ট্রীয় দস্যু। তোমাকে শিক্ষা দিয়ে কি আমি জাতির জন্য আরেকটা সুযোগ্য ঘাতক জন্ম দেব? সুতরাং আজ আমরা যে দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রবেশ করতে যাচ্ছি এটাও আমাদের সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটা আশার কথা। নদীর প্রথম বর্ষার উন্মত্ত হিংস্রতার পর জলধারা কিছুটা সুস্থির হয়। সব সময়ই দ্বিতীয় প্রজন্ম প্রথম প্রজন্মের তুলনায় তুলনামূলকভাবে আর্থিক কষ্ট সম্পর্কহীন, নির্লোভ, উদার মূল্যবোধ নিয়ে দেখা দেয়। আশা করি আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের বেলাতেও তা ঘটবে। এদের অনেকে অনেক দিন বিদেশে থেকেছে। সেসব জায়গা থেকে পাওয়া বড় মূল্যবোধগুলো এবার আমাদের জাতির কাজে আসবে। দেশের ভেতর আমরাও চেষ্টা করছি তাদের মূল্যবোধ বাড়াতে। আজ তারা শিশু-কিশোর। আমি তাদেরই চাই। কারণ, শিশু মানে আগামী প্রজন্ম, সামনের বাংলাদেশ। তাদের যদি আরও ভালো করে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা সামনে পা ফেলতে পারব।

ধর্মীয় দিক দিয়ে আমাদের সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে প্রথমে বলতে হয়, ধর্ম আমাদের দেশে বহু শতাব্দী ধরে গতিশীল আছে। উনিশ শতাব্দীর ওহাবি আন্দোলনের পর থেকে ইসলাম এ দেশে বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। গত দেড়শ বছরে শুধু ধর্মচর্চাই এই ধর্মীয় চেতনার একমাত্র কারণ ছিল না, অস্তিুত্ব রক্ষার সংগ্রামও এর কারণ ছিল। যেমন- পাকিস্তান মূলত ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না, মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনই ছিল এর মূল বিষয়। যখন পাকিস্তান হয় তখন শতভাগ মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আবার ‘৭১ সালে সেই বাঙালিরাই ধর্মনিরপেক্ষতার অনুকূলে ভোট দিল। কিন্তু তার মানে কি এই যে, ধর্ম আমাদের জীবন থেকে উঠে গেল? না। বরং ধর্ম ব্যাপারটা জাতির জীবনে যে কত গভীরে প্রসারিত তা বোঝা গেল পরবর্তী সময়ে। দেখা গেল, ধর্মীয় রাষ্ট্র আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র- উভয় ধারার প্রবক্তারাই ধর্মের সামনে কী গভীরভাবে নতজানু। আমাদের ছেলেবেলায় এ দেশে এত শহর ছিল না। পুরোটাই ছিল এক আদি-অন্তহীন গ্রামবাংলা। মাঝে মাঝে কাচের টুকরোর মতো চিকচিক করা এত্তটুকু একেকটা শহর। এই গ্রামবাংলার মানুষেরা ছিল ধর্মভীরু, এদের চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ সবই ছিল ধর্মাশ্রিত। এর মাঝখানে ওই শহরগুলো ছিল কিছুটা অন্যরকম। ছোট্ট, কিন্তু আধুনিকতায় ঝলমলে। প্রায় দেড়শ বছর ধরে শহরগুলো প্রায় একরকমভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময় এদের বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। একটা মোক্তারপাড়া, একটা আমলাপাড়া, একটা মাস্টারপাড়া, একটা কলেজ, দুটো স্কুল, বাজার, কোর্ট-কাছারি- এসব নিয়েই শহরগুলো প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিল।

আশ্চর্য যে, এই ছোট্ট শহরগুলোয় আধুনিকতা বা মননের চর্চা ছিল। এমনকি নাস্তিকতারও। ভাগ্য পরিবর্তনের অভাবিত বা আকস্মিক কোনো সম্ভাবনা না থাকায় দৈব নামের জিনিসটির প্রভাব সেখানে ছিল কম। যে পরিবেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুস্থির সেখানে মানুষ হয়ে ওঠে দর্শনমনস্ক ও মননশীল। এই শহরগুলো ছিল সেরকম। আমাদের ছেলেবেলায় ঢাকা ছিল অনেকটা এরকম। সে ছিল চিন্তায়-চেতনায়-মননে আধুনিকতায় পরিশীলিত এক নগরী, প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার সূতিকাগৃহ। আজ এ নগর ঠিক সেখানে নেই। না থাকার কারণ :ষাটের দশকেও ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখ, আর এখন ঢাকার জনসংখ্যা ১১০ লাখ। তাহলে এই ১০০ লাখ মানুষ কোথা থেকে এসেছে? তারা এসেছে গ্রামবাংলা থেকে, ওই গ্রামবাংলারই ধর্ম, সংস্কৃতি, রুচি আর মনমানসিকতা নিয়ে। কাজেই আমাদের ছেলেবেলায় ঢাকা শহরের যে রূপ আমরা দেখেছি, আজকের চেহারা তার থেকে অনেক বেশি গ্রামীণ চরিত্রসম্পন্ন ও পশ্চাৎপদ হয়ে গেছে। ওই ১০০ লাখ মানুষের ধর্মাশ্রিত গ্রামীণ সংস্কৃতি, সনাতন ও অনড় মনমানসিকতা, পশ্চাৎমুখিতা, কুসংস্কার ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশিক্ষা ষাটের দশকের ১০ লাখ মানুষের নাগরিক সংস্কৃতিকে ঢেকে দিয়েছে। ফলে মননসাধনায় ঢাকা শহর অনেক পিছিয়ে গেছে।

এই শহরকে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি গ্রাম্য মনে হয়। তবে এটাও স্থায়ী কিছু নয়। কারণ, সব নগরীরই কিছু আধুনিকতা ও বৈশ্বিক চরিত্র থাকে। বিশ্বের সঙ্গে তাকে একতালে চলতে হয়। সুতরাং এক প্রজন্ম পার হলে আজকে যে শহরকে পিছিয়ে পড়া মনে হচ্ছে, সে হয়তো ততটা পেছনে থাকবে না। সে আরও আধুনিক মননশীল ঐহিক ও মানবিক হবে। ওদিকে আবার আমাদের গ্রামগুলোর সংস্কৃতির গায়েও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তারাও ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। সেখানেও নানারকম উন্নতির স্রোত। মানুষের অধিকার, নারীর অধিকার, জাগতিক আগ্রহ গুরুত্ব পাচ্ছে।

আমরা ছেলেবেলায় যে গ্রাম দেখেছি তা-ও অনেকখানি এগিয়েছে, আধুনিক হয়েছে। সে তুলনায় শহর পিছিয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, শহরগুলোও আবার কিছুদিনের মধ্যেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠবে। গ্রাম আর নগরের বিচ্ছিন্নতা কমে আসবে। এরা হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি এগোবে।
লেখক
কবি
প্রাবন্ধিক
সংগঠক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.