রাজশাহীর বাসিন্দা আনাস ভূঁইয়া কয়েক দিন আগে হার্টের সমস্যা নিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তাঁর অ্যাওটিক ভাল্ভ্ প্রতিস্থাপন করতে হবে। তবে সরবরাহ সংকটে দেড় মাস ধরে এই হাসপাতালে এ ভালভ প্রতিস্থাপন বন্ধ রয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর স্বজনকে জানিয়ে দিয়েছে, এ সরঞ্জাম আসতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে। এ কথা শুনে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান রোগীর স্বজনরা। পরে ওই হাসপাতালের একজন ওয়ার্ডবয়ের সহযোগিতায় অ্যাওটিক ভালভের ব্যবস্থা হয়। সেটা বিদেশ থেকে অবৈধ পথে আনা। সেই ভাল্ভ্ আনাসের শরীরে প্রতিস্থাপন হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম এনে অনৈতিক ব্যবসা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র ডলার সংকটে এলসি খোলায় জটিলতায় দেশের নিবন্ধিত কোম্পানিগুলো হৃদরোগীদের জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য হার্টের রিং, অ্যাওটিক ভাল্ভ্, পেসমেকার, বেলুন ও অক্সিজেনেটর চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারছে না। এই সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র। অবৈধ পথে আনছে হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম।
ভারত থেকে এসব সরঞ্জাম বেশি আসে। এ ছাড়া দুবাই, আমেরিকাসহ বেশ কিছু দেশ থেকে অবৈধ পথে নিয়ে আসা হচ্ছে এসব সরঞ্জাম। এতে সরকারও বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রথমেই নিজেদের হার্টকে জানা’। দিবসটি উপলক্ষে হৃদরোগ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে প্রায় ২০টি কোম্পানি বৈধভাবে হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম দেশে আনছে। দীর্ঘদিন ওমেকা হেলথ কেয়ার নামের একটি কোম্পানি আমেরিকার বায়োজেন কোম্পানির সরঞ্জাম নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করছে। সম্প্রতি সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বায়োজেনের চিকিৎসা সরঞ্জাম অবৈধভাবে এনে সরবরাহ করছে।
সর্বশেষ গত মাসে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে বায়োজেনের সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য চুক্তি করতে গিয়েছিলে অবৈধ সিন্ডিকেটের এক প্রতিনিধি। হার্ট ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকরা বিষয়টি ওমেকা হেলথ কেয়ারকে জানান। ওই কোম্পানি খোঁজ নিয়ে দেখে, এ অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ওয়ার্ডবয় আসাদুল জামান টিটু মিয়া। পরে থানায় মামলা করতে গেলেও নেয়নি। এর সঙ্গে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কিছু চিকিৎসকও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, আগে প্রতি মাসে সেখানে প্রায় ৩০০ জন রোগীর হার্টের বাইপাস সার্জারি, ওপেন হার্ট সার্জারি, ভালভ প্রতিস্থাপন হতো। কিন্তু অক্সিজেনেটরের অভাবে সেপ্টেম্বরে মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন রোগীর অপারেশন হয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, গত কয়েক মাস ধরেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের প্রায় ১৫টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের অপারেশনের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ থেকে ১২০টি ভালভের প্রয়োজন হয়। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে ভালভ রিপ্লেসমেন্টের কাজ বন্ধ রয়েছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একজন অধ্যাপক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অনেক রোগীর স্বজন অবৈধভাবে হৃদরোগ চিকিৎসার সরঞ্জাম এনে অস্ত্রোপচার করাচ্ছেন। এতে তিন ধরনের ঝুঁকি বাড়ছে। প্রতিটি সরঞ্জাম একটি নির্দিষ্ট তাপ মেনে সংরক্ষণ করে আনতে হয়। তবে অবৈধভাবে যে সরঞ্জামগুলো আনা হচ্ছে, এতে তাপ মেনে সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন। অন্যদিকে রোগীর জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এ সংকট নিরসনে সরকারের উচিত এসব পণ্যে সুনির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক নূরুল আলম বলেন, সরকার অবৈধভাবে হার্টের চিকিৎসা সরঞ্জাম আনা বন্ধে কাজ করছে। মাঝে মাঝে লিখিত অভিযোগ পেলে অভিযান পরিচালনা করা হয়। মামলা, জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই দফায় ছয় ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো হয়েছে। আরও কিছু কোম্পানির হার্টের রিংয়ের দাম কমাতে দু-একদিনের মধ্যে বৈঠক করা হবে। এসব সরঞ্জামের সুনির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণে কাজ চলছে।