অ্যাপ খুলে ৬ মাসে ৩০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দিলেন চীনের নাগরিক

0
156
টাকা- প্রতীকী ছবি

ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতেন ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আবু তালহা। গত বছরের অক্টোবরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি লিংক আসে। সেই লিংকে ঢুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান তিনি। চটকদার সেই বিজ্ঞাপনে বলা ছিল, ‘“বরগাটা”নামের একটি অ্যাপ নামিয়ে সেখানে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে দৈনিক ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করুন।’ বিজ্ঞাপনটি দেখে ধাপে ধাপে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তালহা। এর তিন মাস পর টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় অ্যাপভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠান।

এ ঘটনায় আবু তালহা বাদী হয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর চকবাজার থানায় মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক চীনা নাগরিকসহ ১২ জনকে শনাক্ত করে। তাঁদের মধ্যে ৯জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে পালিয়ে যান চক্রের হোতা চীনা নাগরিক কেভিন চেন (৪০)।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তদন্তের শুরুতেই মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানের (এমএসএফ) একটি ‘মার্চেন্ট’ অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া যায়। সেই অ্যাকাউন্টের লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মাত্র ১৪ দিনে অ্যাকাউন্টে ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। অস্বাভাবিক এই লেনদেনের সূত্র ধরে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা জানতে পারেন, এ বি সিদ্দিকী নামের এক ব্যক্তির নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে অ্যাকাউন্টটি খোলা হয়েছে। তবে অ্যাকাউন্ট খোলার এক মাস আগেই মারা গেছেন মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা এ বি সিদ্দিকী।

গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর—এই ছয় মাসে ‘টিএনএস’ ও ‘বরগাটা’ নামে দুটি অ্যাপ বানিয়ে মোট ৯৯১ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কেভিন ও তাঁর সহযোগীরা। সফটওয়্যার ব্যবসার নামে কেভিন বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা করে আসছিলেন।

সিআইডি সূত্র জানায়, মৃত ব্যক্তির নামে ‘মার্চেন্ট’ অ্যাকাউন্ট খুলে সেটি ব্যবহার করছিলেন চীনা নাগরিক কেভিন। তিনি প্রায় তিন বছর ধরে নতুন নতুন অ্যাপ বানিয়ে ঋণ ও বিনিয়োগের ফাঁদে ফেলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতেন কয়েক বাংলাদেশি নাগরিক। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর—এই ছয় মাসে ‘টিএনএস’ ও ‘বরগাটা’ নামে দুটি অ্যাপ বানিয়ে মোট ৯৯১ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কেভিন ও তাঁর সহযোগীরা। সফটওয়্যার ব্যবসার নামে কেভিন বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণা করে আসছিলেন।

ছয় মাসে ৩০০ কোটি টাকা তুলে নেয় চক্রটি

সিআইডি সূত্র জানায়, তিন বছর আগে বাংলাদেশে আসেন কেভিন চেন। তিনি ‘পিসেস টেকনোলজি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিভিন্ন অ্যাপ তৈরি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন। নতুন নতুন অ্যাপ খুলে ছয় থেক এক বছর চালাতেন। বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করার পর সংশ্লিষ্ট অ্যাপটি বন্ধ করতেন। আবার নতুন অ্যাপ চালু করতেন। এভাবে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন কেভিন। তাঁর বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় আরেকটি মামলা রয়েছে।

মৃত ব্যক্তির নামে ‘মার্চেন্ট’ অ্যাকাউন্ট খুলে সেটি ব্যবহার করছিলেন চীনা নাগরিক কেভিন। তিনি প্রায় তিন বছর ধরে নতুন নতুন অ্যাপ বানিয়ে ঋণ ও বিনিয়োগের ফাঁদে ফেলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতেন কয়েক বাংলাদেশি নাগরিক।

কেভিনের প্রতারণার শিকার ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আবু তালহা মামলার এজাহারে অভিযোগ করেছেন, গত বছরের অক্টোবরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি লিংক আসে। সেই লিংকে ঢুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান। বিজ্ঞাপন দেখে দুই অ্যাপ মুঠোফোনে নামিয়ে প্রথম চার দিনে কোনো কাজ না করেই ৪০০ টাকা পান তিনি। এর কয়েক দিন পর একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাঁকে যুক্ত করা হয়। পরে আরেকটি বার্তায় তাঁকে বলা হয়, ‘বরগাটা নামের আরেকটি অ্যাপ নামিয়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে দিনে ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করুন।’

আবু তালহা গতকাল শনিবার বলেন, ‘টিউশনি করে জমানো টাকা থেকে প্রথমে আমি ১০ হাজার টাকা অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করি। পরে শর্ত দেওয়া হয়, বিনিয়োগ করতে হলে অ্যাপে সব সময় ১০ হাজার টাকা জমা রাখতে হবে। পরে আমি আরও দুই হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। অ্যাপ পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা দুই হাজার টাকার মধ্য থেকে প্রথমে দেড় হাজার টাকা বিনিয়োগ করে। আমি দিনে আড়াই শ টাকা পেতে থাকি।’

শুরুতে কয়েক দিন কিছু টাকা লাভ পেয়েছিলেন উল্লেখ করে আবু তালহা বলেন, পরে ধাপে ধাপে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। এর মধ্যে ২০ হাজার টাকা বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরের দিকে এসে অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানি বিনিয়োগ করে সমস্যায় পড়েছে জানিয়ে তিন-চার দিন পর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আরেকটি বার্তা আসে। এতে বলা হয়, যাঁরা আজকের মধ্যে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন, তাঁরা আগের টাকাসহ ফেরত পাবেন। আশ্বস্ত হয়ে নতুন করে আবার বিনিয়োগ করেন। পরে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা।

সিআইডি জানায়, ৯ জনকে গ্রেপ্তারের পর কিছু ডিজিটাল ডিভাইস ও এমএসএফ অ্যাকাউন্ট নম্বর জব্দ করা হয়। এতে দেখা যায়, কেভিন গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর—এই ছয় মাসে নতুন দুটি অ্যাপ খুলে মোট ৯৯১ ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে চীনে পালিয়ে গেছেন। অ্যাপ দুটিতে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিলেন কেউ কেউ।

যেভাবে খোলা হয় মৃত ব্যক্তির নামে অ্যাকাউন্ট

সিআইডি সূত্র জানায়, এ বি সিদ্দিকী একটি চীনা কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে চাকরি করতেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি কেভিন চেনের অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘টিএনএস’ ও ‘বরগাটা’য় কিছুদিন এমডির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সুবাদে এ বি সিদ্দিকীর জাতীয় পরিচয়পত্রসহ তাঁর ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য ও কাগজপত্র কেভিনের কাছে ছিল। এ বি সিদ্দিকী মারা যাওয়ার এক মাস পর তাঁর নামে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান বা এমএসএফের ‘মার্চেন্ট’ অ্যাকাউন্ট খোলেন কেভিন। অবৈধ সুবিধা নিয়ে এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন এমএসএফ প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা। কেভিনের সহযোগী হিসেবে ওই এমএসএফ কোম্পানির সেই কর্মকর্তা এস এম আবু সায়েমকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার সায়েমের বিরুদ্ধে এমএসএফ ব্যবস্থা নিয়েছে। এ বি সিদ্দিকীর নামে অ্যাকাউন্ট রয়েছে, সেটা জানতেন না তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তদন্তের শুরুতে তাঁর ছেলে-মেয়েকেও হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে এ বি সিদ্দিকীর মেয়ে ফাতেমা আক্তারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। গত শুক্রবার তিনি বলেন, তাঁর বাবা এক বছর আগে মারা গেছেন। তবে কীভাবে তাঁর মৃত বাবার নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, সে বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডির সাইবার পুলিশ কেন্দ্র। সাইবার পুলিশ কেন্দ্রের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল করিম মাসুদ বলেন, এমএসএফের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে যেসব শর্ত থাকে, সেগুলো না মেনেই অ্যাকাউন্টটি চালু করা হয়েছিল। এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে এমএসএফ অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.