ডিশের বিল সংগ্রাহক থেকে কোটিপতি আ’লীগ নেতা!

0
163
মোশাররফ হোসেন

ছিলেন ডিশ ব্যবসার বিল সংগ্রাহক। ঘনিষ্ঠজনকে কাজে লাগিয়ে মালিকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা ঠুকে দেন। পরে সমঝোতার নামে তাঁর কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ব্যবসা। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষমতাসীনদের ওপর ভর করে শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। তিনি রাজধানীর শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মোশাররফ হোসেন। তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে একাধিক দোকান দখল, আজিজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির সদস্যদের গাড়ি রাখার পার্কিংয়ের র‍্যাম্পে খাবার হোটেল ও কার্যালয় দিয়ে কর্মকাণ্ড, সাধারণ ব্যবসায়ীদের মারধর, ফ্ল্যাট দখলসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ-সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণের নথি হাতে এসেছে। তবে এসব মিথ্যা দাবি করে মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমি এবার শাহবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য একটি মহল নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। অবৈধ কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি জড়িত নই। যেসব সম্পদ গড়েছি, তার পক্ষে সব ধরনের কাগজপত্র রয়েছে।’

জানা যায়, রাজধানীর বাংলামটরের বাসিন্দা মৃত হারুন-অর-রশিদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডে (আগের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড) ডিশ লাইনের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৩ সালে তাঁর ব্যবসার বিল সংগ্রহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন সৈয়দ মোশাররফ হোসেন। এ ব্যবসা বাগিয়ে নিতে ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করান তিনি। পরে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি হিসেবে হারুনের অর্ধেক এলাকার ব্যবসা দাবি করেন মোশাররফ। তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবে পর্যুদস্ত হয়ে এক পর্যায়ে ব্যবসা দিতে বাধ্য হন হারুন, যার স্বীকারোক্তিপত্র এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। যদিও স্বীকারোক্তিপত্রে মামলার বিষয় উল্লেখ করা হয়নি।

চুক্তিপত্রের সময় উপস্থিত একাধিক সাক্ষী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মোশাররফের এটিসহ নানা অপকর্মের কথা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, মোশাররফ বর্ণচোরা। যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন সেখানে নোঙর করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগে এসে প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়েছেন। শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সৈয়দ মোশাররফ ভয়ভীতি দেখিয়ে আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় ও নিচতলায় খন্দকার মনির উদ্দিন আহম্মদ নামে এক ব্যবসায়ীর চারটি দোকান প্রায় ৩০ বছর দখলে রেখেছেন এবং শুরু থেকেই হোল্ডিং ট্যাক্স দেন না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মার্কেটের দোতলার ৩৫ নম্বর দোকানের ১৯৯৭-৯৮ সালের প্রথম কিস্তি থেকে ২০২২-২৩ সালের চতুর্থ কিস্তি পর্যন্ত ৮৯ হাজার ২৫০, ৪২ নম্বর দোকানের ১৯৯৯-২০০০ সালের প্রথম কিস্তি থেকে ২০২২-২৩ সালের চতুর্থ কিস্তি পর্যন্ত ৮২ হাজার ৩৫০, ১৯৯৮-৯৯ সালের দ্বিতীয় কিস্তি থেকে ২০২২-২৩ সালের চতুর্থ কিস্তি পর্যন্ত ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৭৫ টাকা এবং নিচতলার ৬০ নম্বর দোকানের ১৯৯৪-৯৫ সালের প্রথম কিস্তি থেকে ২০২২-২৩ সালের চতুর্থ কিস্তি পর্যন্ত ৯৯ হাজার ৬০০ টাকা বকেয়া। জানতে চাইলে দোকানগুলোর ব্যবসায়ীরা জানান, সৈয়দ মোশাররফের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তারা ব্যবসা করছেন। হোল্ডিং ট্যাক্স বকেয়ার বিষয়ে জানা নেই। শাহবাগের আজিজ মেডিসিন মার্কেটে বৈধভাবে দোকানের মালিকানা না থাকলেও সৈয়দ মোশাররফ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মার্কেট সমিতির সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, মেডিসিন মার্কেটের ভেতরের কয়েকটি কমন স্পেসকে দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন তিনি, যার বৈধ কাগজপত্র নেই। মার্কেটের নিচতলায় নুসরাত ফার্মেসি ও এক্সএল ফার্মেসি এবং দোতলায় জিএস সার্জিক্যাল নামে তিনটি দোকান মোশাররফ ভাড়া দিয়েছেন। মোশাররফের বিরুদ্ধে আজিজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি ভবনের বাসিন্দাদের জন্য নির্মিত চারতলা পর্যন্ত পার্কিংয়ের গাড়ি ওঠানোর র‍্যাম্প দখল করে ‘রসনা বিলাস হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ র‍্যাম্প উদ্ধারে গত বছর ২০ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বরাবর অভিযোগ দেন ভবনের স্থায়ী বাসিন্দারা। পরে সামাজিক বৈঠকে কাউন্সিলর ডাকলেও সাড়া দেননি মোশাররফ। সরেজমিন র‍্যাম্পের জায়গায় নির্মিত হোটেলটিতে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এ র‍্যাম্পের নিচের খালি জায়গায় তিনি ব্যক্তিগত কার্যালয় দিয়েছেন।

মোশাররফ ২০১৭ সাল থেকে রাজধানীর পরীবাগের হাবিবুল্লাহ রোডের এম্পায়ার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের মালিকানাধীন ‘আকবর নকশী প্যালেস’-এর ৮/এ নম্বর ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন। কিন্তু গত এক বছর তিনি ফ্ল্যাটের ভাড়া দেন না। চাইলে উল্টো গ্রুপের লোকজনের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ এম্পায়ার ডেভেলপমেন্টের। ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর ও গত বছর ৩১ জানুয়ারি বকেয়া পরিশোধে মোশাররফকে দুটি লিখিত এবং ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ দেয় কোম্পানি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ভবনের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শাহ মো. সোহেল ও তত্ত্বাবধায়ক মো. ফেরদৌসকে ভয়ভীতি এমনকি প্রাণনাশের হুমকি দেন তিনি।

এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় ভুক্তভোগীরা জিডি করেন। আকবর নকশী প্যালেস ফ্ল্যাট মালিক সমিতিতে ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিটি লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো সমাধান হয়নি। পরে গত বছর ১০ মে ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন তারা। কাউন্সিলর আসাদ বলেছেন, অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সামাজিক বৈঠকে উপস্থিত হতে মোশাররফ হোসেনকে নোটিশ দিলেও কখনও তিনি আসেননি।

মাজহারুল ইসলাম রবিন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.