ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪ জনের মৃত্যু ১১১ শিশুর জীবন কেড়ে নিল

0
137

এবারের ডেঙ্গুর আক্রমণ চতুর্মুখী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেককে চলে যেতে হয় আইসিইউ পর্যন্ত। আর তখনই পেয়ে বসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ইচ্ছেমতো বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় রোগীর অভিভাবকের হাতে। আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের আবেগ-অনুভূতিকে পুঁজি করে জোরেশোরে ব্যবসা শুরু করেছে বহু বেসরকারি হাসপাতাল।

সরকারি হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা এবং আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে অনেকে রোগী নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে যাচ্ছেন। এ সুযোগটিই তারা বেশ ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে।

দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৩৪ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে আক্রান্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৪২ জনে। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে একদিনে সারা দেশে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৭ জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ হাজার ৫৩৪ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫৮৯ জন। ঢাকার বাইরে ৯৪৫ জন। এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১ জন এবং ঢাকার বাইরের ৩ জন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৪২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫৮ হাজার ৬১০ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৬৬ হাজার ৭৩২ জন। এছাড়া এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে মোট ছাড়পত্র পেয়েছেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৯৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫৪ হাজার ৩৫৩ জন এবং ঢাকার বাইরের ৬২ হাজার ৪৪ জন।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি কন্ট্রোল রুম এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম শাখার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সি ১১১ শিশু-কিশোরের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুর মধ্যে মেয়ে শিশু ১৪, ছেলে শিশু ৯, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সি মেয়ে শিশু ১৬, ছেলে ১৩, ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সি মেয়ে শিশু ৯, ছেলে শিশু ১০ এবং ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সি মেয়ে ১৯, ছেলে ২১ জন।

প্রাপ্ত হিসাবে দেখা যায়, এ সময়ে মেয়ে শিশু মারা গেছে ৫৮ জন, ছেলে ৫৩ জন। সরকারি এই হিসাবের বাইরেও বেশকিছু শিশু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কিন্তু ডেঙ্গু রোগী হিসাবে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে অনেক মৃত্যু হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

অপর দিকে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রমরমা ব্যবসা শুরু করেছে। বিশেষ করে আইসিইউতে ভর্তি রোগীর পরিবারের ওপর অসহনীয় চাপ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করছে। সন্তান যখন মৃত্যুর মুখে তখন আর কোনো উপায়ান্তর থাকে না।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের (প্রধান শাখা) ইংরেজি ভার্সনের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাইজা আনবার আমিরার ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার খবরটি ১২ জুলাই কলেজের ফেসবুক গ্রুপে দিয়ে দোয়া চাওয়া হয়।

ফাইজার অবস্থা খারাপের দিকে গেলে মৌচাকে অবস্থিত ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে আইসিইউ সাপোর্ট নেওয়া হয় ৪ দিন। এই ৪ দিনে আইসিইউসহ খরচ হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এত টাকা বিল দেখে ফাইজার বাবা বিস্মিত হন। রাজধানীর শান্তিবাগ শহীদবাগের বাসিন্দা মুশফিকুর রহমান একজন ব্যবসায়ী। তারপরও তিনি বিল শোধ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েন।

তিনি বলেন, হুট করে এত টাকা সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। মনে হয়েছে, যত টাকা লাগে লাগুক, আগে মেয়ের জীবন। এভাবে অনেক বাবা-মা তার ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানের জীবন রক্ষায় হাসপাতালের পেছনে লাখ লাখ টাকা দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। কিন্তু ভালোবাসার ধনকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের আর কোনো বিকল্পও নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে চলতি বছর ১ হাজার ৭৭ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৭৮ জনের আইসিইউ সাপোর্টের প্রয়োজন হয়েছে। শুক্রবার ১১ শিশু আইসিইউতে ভর্তি ছিল। শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুহার ১ দশমিক ২৯ শতাংশ। বর্তমানে ১১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি রয়েছে।

শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গুসহ যে কোনো অসুখে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। শিশুদের ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের ডেঙ্গু হলেই পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের পালমোনারি হেমারেজ বেশি হয়।

সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে মালটি-অরগান ফেইলর হয়ে শিশু মারা যেতে পারে। এছাড়া তাদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইন দেওয়া যায় না। তিন মাসের নিচের বাচ্চাদের বেবি স্যালাইন লাগে। শিশুদের ফ্লুইড প্রয়োগের হিসাব একটু কঠিন। রোগের ধরন বুঝে সঠিক মাত্রায় ফ্লুইড দিতে না পারলে, ওভার ডোজ পড়লে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, দেশে চিকিৎসা খরচের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণা সঠিকভাবে হচ্ছে না। ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন ও ওষুধপথ্য সংকটের কথা প্রায়ই আলোচনা হচ্ছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর ব্যক্তিগত খরচ বাড়ছে।

২০১৮ ও ২০২০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, যে কোনো ধরনের রোগের চিকিৎসায় ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হয় ৬৯ শতাংশ, যা ২০১৮ সালেও ৬৪ শতাংশ ছিল। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় মানুষ প্রথমে সরকারিতেই যাবে। কিন্তু সেখানে চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সেবা ও নিবিড় পরিচর্যার শয্যা (আইসিইউ) না পেলে বাধ্য বেসরকারিতে যাবে। সেখানে খরচ বহন করতে না পারলে হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা নেবে। তাতে মৃত্যু হার বাড়বে। আক্রান্ত-মৃত্যুর সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না।

হাসপাতালে ভর্তির ৭২ ঘণ্টায় ৯০ ভাগ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু : চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গড়ে ৭৫ জন মারা গেছেন। আর মোট মৃত্যুর শতকরা ৯০ ভাগই হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে (৭২ ঘণ্টা) মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণ রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। শুক্রবার রাজধানীর গুলশানে এডিস মশার বর্ষাকালীন জরিপ পরিচালনাকালে এ কথা জানান তিনি।

এই কর্মকর্তা বলেন, জ্বর হলে তো ৪-৫ দিন পর রোগীর অবস্থা খারাপ হওয়ার কথা। তাহলে ৩ দিনের মাথায় মৃত্যুর মানে-তার এই রোগের শুরু আরও আগে। প্রথমে সে চিকিৎসকের কাছে যায়নি। যখন এসেছে, তার অবস্থা ইতোমধ্যেই খারাপ হয়ে গেছে।

গত ১০ দিন ধরে রাজধানীতে এডিস মশার বর্ষাকালীন জরিপ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ জরিপের অংশ হিসাবে গুলশান-বনানীর বিভিন্ন বাসাবাড়িতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব নমুনা পরীক্ষা করে মিলছে এডিস মশার লার্ভা।

সবশেষ শুক্রবার রাজধানীর গুলশান-১ এর একটি বহুতল ভবনের গ্যারেজে এডিসের লার্ভাবিরোধী অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অভিযানে ভবনটির গ্যারেজে বোতল ও গাড়ির টায়ার পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রথম ৮ দিনে সংগৃহীত নমুনায় শতকরা ৫০ ভাগ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো দেওয়া হলো না তরুণ অভিনেত্রীর : এইচএসসি পরীক্ষার্থী তরুণ অভিনেত্রী নিশাত। দুদিন আগেও ছিলেন প্রাণবন্ত। ফেসবুকে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করছিলেন। জ্বর থেকে সেরে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাততে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯ বছরের নিশাতের সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না।

বৃহস্পতিবার মারা গেছেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন)। জানা গেছে, চার দিন আগে হঠাৎই জ্বরে আক্রান্ত হন নিশাত আরা আলভিদা। প্রথম দিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও পরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তার প্লাটিলেট কমতে থাকে। অবশ্য এক দিনের মাথায় প্লাটিলেট আবার বাড়তেও থাকে। কিছুটা সুস্থ বোধ করায় বাসায় চলে আসেন। পরে বাসায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.