দেশের বকেয়া ও মেয়াদ বাড়ানো বৈদেশিক ঋণ এবং আমদানির দায় পরিশোধের চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এসব দায় মেটাতে প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অব্যাহত গতিতে কমে যাচ্ছে। যা দেশের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, চাল, গমসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এতে আমদানি ব্যয় আবারও বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতেও ডলারের চাহিদা বেড়েছে। রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ ও বৈদেশিক অনুদানও নিম্নমুখী। এসব কারণে রিজার্ভের ওপর আগামীতে চাপ আরও বেশি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ঋণের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অনুপাত কমে আসছে। ঋণ বাড়া ও রিজার্ভ কমার কারণেই এমনটি হচ্ছে। এতে ঝুঁকিও বাড়ছে। যদিও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) মনে করে, বৈদেশিক ঋণের দিক থেকে বাংলাদেশের ঝুঁকি নিম্নমানের। তবে রিজার্ভ অব্যাহতি গতিতে কমে যাওয়া উদ্বেগের মনে করে।
মোট ঋণের মধ্যে রিজার্ভ ২০১৭ সালে ৬৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৫৬ দশমিক ১০ শতাংশে। ২০১৯ সালে তা আরও কমে ৫১ দশমিক ৯০ শতাংশ হয়। ২০২০ সালে রিজার্ভ বাড়ায় অনুপাত বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ দশমিক ২০ শতাংশে। ২০২১ সালে করোনার কারণে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেড়ে যায়। তখন রিজার্ভের অনুপাত কমে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৮০ শতাংশ। ২০২২ সালে তা আরও কমে ৩৫ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। গত মে পর্যন্ত তা আরও কমে ৩০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমলে ও বৈদেশিক ঋণ বাড়লে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি বাড়বে। বিদেশিদের মনে আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন দেশে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা দেখা দেবে। বর্তমানে ডলার বাজারে অস্থিরতার একটি কারণ বৈদেশিক ঋণ। বিদেশি ঋণ উৎপাদনমুখী কাজে লাগালে এত চাপ পড়ত না। কিন্তু তা করা হয়নি। এখন বৈদেশিক ঋণের ব্যবহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হওয়া উচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মার্চে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স থেকে পাওয়া ডলার দিয়ে আমদানি ব্যয় মিটিয়ে সমান সমান থাকত। ওই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৬৪ কোটি ডলার ও রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৮ কোটি ডলার। দুই খাতে আয় হয়েছে ৬৪২ কোটি ডলার। ওই মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬২৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত ছিল ১৬ কোটি ডলার। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে এ খাতে ঘাটতি হতো। বর্তমানে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স থেকে পাওয়া ডলার দিয়ে আমদানি ব্যয় মিটিয়ে কিছু ডলার উদ্বৃত্ত থাকছে। গত জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ডলার ও রপ্তানি আয় হয়েছে ৪৫৯ কোটি ডলার। দুই খাত মিলে মোট আয় হয়েছে ৬৫৬ কোটি ডলার। এর বিপরীতে ওই মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৪৮৭ কোটি ডলার। উদ্বৃত্ত থাকছে ১৬৯ কোটি ডলার।
মার্চের তুলনায় জুলাইয়ে উদ্বৃত্ত ১৫৩ কোটি ডলার বাড়লেও সংকট মিটছে না। বরং আরও প্রকট হচ্ছে। কারণ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। উদ্বৃত্ত এসব ডলারের একটি বড় অংশই খরচ হয়েছে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে। কিছু অংশ গেছে আগের এলসির দায় পরিশোধে। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে রিজার্ভ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কোটি ডলারের বেশি জোগান দিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। গত অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ১১৩ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বিক্রি করেছে ১৮০ কোটি ডলার।
এ হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ৯০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এ কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বের হচ্ছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয় কম হওয়ায় রিজার্ভে ডলার যোগ হচ্ছে কম। যে কারণে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। ২০২১ সালের আগস্টে গ্রস রিজার্ভ বেড়ে সর্বোচ্চ চার হাজার ৮০৬ কোটি ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে নিট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩০৭ কোটি ডলার। গত দুই বছরে রিজার্ভ কমেছে দুই হাজার ৪৯৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ রিজার্ভ কমেছে ৫২ শতাংশ। বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকটের কারণে গত দুই বছর ধরেই রিজার্ভ নিম্নমুখী।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ৯ হাজার ৬২৫ কোটি ডলার। গত মে মাসে তা কমে এসেছে ৯ হাজার ৪৭১ কোটি ডলারে। আলোচ্য সময়ে ঋণ কমেছে ১৫৪ কোটি ডলার। নতুন ঋণ কম নেওয়া ও আগের ঋণ শোধ করার কারণে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি কমেছে। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ঋণ বেড়েছিল ৫৪৫ কোটি ডলার। বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ।
বর্তমান ঋণের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সাত হাজার ৭৭২ কোটি ডলার। যা মোট ঋণের ৮০ দশমিক ৭০ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদি ঋণ এক হাজার ৮৫৩ কোটি ডলার। যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। সরকারি খাতের ঋণ সাত হাজার ১৯৪ কোটি ডলার। যা মোট ঋণের ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। বেসরকারি খাতে দুই হাজার ৪৩১ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি, সরকারি খাতে কম। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ হচ্ছে এক হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণই এখন রিজার্ভের ওপর বড় চাপ তৈরি করেছে।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণ লম্বা সময় ধরে পরিশোধের সুযোগ থাকে। যে কারণে এ ঋণে রিজার্ভের ওপর চাপ কম পড়ে। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ঋণ তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়। এ ঋণের পরিশোধে ব্যর্থ হলে মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ থাকে। তখন এর বিপরীতে চড়া সুদ ও দণ্ড সুদ দিতে হয়। যে কারণে খরচ বাড়ে। এতে রিজার্ভে চাপও বাড়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ১৬২ কোটি ডলারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করতে হবে। এর মধ্যে সুদ ৩৬ কোটি ডলার। আগামী বছর শোধ করতে হবে ১৭৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে সুদ ৩২ কোটি ডলার। ২০২৫ সালে শোধ করতে হবে ১০৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে সুদ ২৮ কোটি ডলার। এরপর থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ বছরে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসবে। তবে নতুন ঋণ যোগ করলে তা বেড়ে যাবে।
স্বল্পমেয়াদি ঋণের প্রায় পুরোটাই আমদানির বিপরীতে নেওয়া। এর মধ্যে চলতি বছরেই শোধ করার কথা এক হাজার ২০০ কোটি ডলার। কিন্তু ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর কারণে শোধ করতে হবে প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের মতো। বাকি ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ডলার সংকট অব্যাহত থাকলে এসব ঋণ পরিশোধের মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে।