চালের মজুত পর্যাপ্ত, কারসাজি না হলে বাড়বে না দাম

0
171
চাল

চাল রপ্তানিতে ভারত একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ করছে। সম্প্রতি মিয়ানমারও রপ্তানি বন্ধের আভাস দিয়েছে। এতে উদ্বেগ বাড়ছে চাল আমদানিকারক দেশগুলোতে। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এর কোনো আঁচ লাগেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে। বাজারে প্রভাব পড়বে না।

সরকারি কর্মকর্তারা জানান, বোরো ফলন ভালো হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে। এই চাল শেষ হওয়ার আগেই কৃষকের ঘরে উঠবে আমন ফসল। তাই আমদানির প্রয়োজন হবে না। সরকারের এমন বক্তব্যকে সমর্থন করছেন চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশে এই মুহূর্তে যে পরিমাণ ধান ও চাল মজুত আছে, তাতে কোনো দেশ রপ্তানি বন্ধ করলেও প্রভাব পড়বে না। ভোক্তা অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও মনে করেন, কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কারসাজির চেষ্টা না করলে বাজার অস্থির হবে না।

ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্ববাজারে মোট চালের ৪০ শতাংশই সরবরাহ করে দেশটি। অভ্যন্তরীণ বাজার স্বাভাবিক রাখতে গত জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে ভারত আতপ চাল (নন-বাসমতী হোয়াইট রাইস) রপ্তানি বন্ধ করে। গত শুক্রবার নতুন করে সেদ্ধ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ভারত সরকার বলেছে, ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত এ শুল্ক বহাল থাকবে। নিজেদের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল রপ্তানিতে শিগগিরই সাময়িক বিধিনিষেধ আরোপের পরিকল্পনা করছে মিয়ানমারও। তবে দেশটির রপ্তানি কম। এসব সিদ্ধান্তে কিছুটা অস্থির হয়ে উঠছে চালের আন্তর্জাতিক বাজার।

উৎপাদন ভালো হলেও বাংলাদেশকে প্রতিবছর চাল আমদানি করতে হয়। এর বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে।

মাসখানেক ধরে দেশে চালের বাজার স্থিতিশীল। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট ও তেজকুনিপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোটা তথা গুটি স্বর্ণা ও চায়না ইরি জাতের চালের কেজি ৫০ থেকে ৫২ টাকা, মাঝারি (পাইজাম, লতা ও বিআর-২৮ জাত) চাল ৫৩ থেকে ৫৬, চিকন বা মিনিকেট চালের কেজি মানভেদে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল চাল কিনতে ক্রেতাকে কেজিতে খরচ করতে হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা।

কারওয়ান বাজারের সবচেয়ে বড় পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ইসমাইল অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, সেদ্ধ চালের বাজারে এক মাস ধরে কোনো নড়চড় নেই। দাম মোটামুটি আগের মতোই। বেচাকেনা কম থাকায় চালের বাজার এখন মন্দা।

সুগন্ধি চালের বাজার বাড়তি

সেদ্ধ চালের দাম না বাড়লেও বেড়েছে সুগন্ধি তথা পোলাওর চালের দাম। সুগন্ধি চাল আমদানি করার পাশাপাশি রপ্তানিও করে বাংলাদেশ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১০ থেকে ১২ হাজার টনের মতো রপ্তানি হয়। বছরে উৎপাদন হয় ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। গত ৩০ জুলাই সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে এ ধরনের চালের বাজার বাড়তি। কেজিতে দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। খুচরা বাজারে এখন সুগন্ধি তথা পোলাওর চালের কেজি খোলা অবস্থায় বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা। মাসখানেক আগে কেনা যেত ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। তবে প্যাকেটজাত সুগন্ধি চালের দাম আরও বেশি। এক-দেড় মাসের ব্যবধানে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সুগন্ধি চাল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে। ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, সেদ্ধ চালের দাম না বাড়লেও সুগন্ধি চালের দাম বেড়েছে মিলগেটে। খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এটা অস্বাভাবিক বলা চলে।

চালকল মালিকরা যা বলছেন

চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করুক কিংবা শুল্ক আরোপ করুক কোনোটিতে দেশের বাজারে প্রভাব পড়বে না। কারণ কৃষক ও মজুতদারদের কাছে পর্যাপ্ত চাল আছে। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আব্দুল হান্নান বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের কাছে যে চাল রয়েছে, সেগুলোই তো বিক্রি হচ্ছে না। আমদানি করে কী করবে। আমন ধান উঠলে চালের সরবরাহ আরও বাড়বে। সরকার ওএমএস ও ভিজিডিসহ নানা কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি মূল্যে চাল দিচ্ছে। এ কারণে বাজারে চাহিদা কম। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান সাকি বলেন, এখনও কৃষকের কাছে প্রচুর ধান আছে। বাজারে ঘাটতির কোনো আশঙ্কা নেই।

বরাবরই আমদানির বিপক্ষে বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন রনি। তিনি বলেন, আমদানি করলে কৃষক ধানের দাম পান না। দেশে চালের যে মজুত আছে, তাতে সংকট হবে না।

আমদানিকারকরাও মনে করেন প্রভাব পড়বে না। জয়পুরহাটের চাল আমদানিকারক হেনা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আব্দুল হাকিম মণ্ডল বলেন, ভারত রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। বাংলাদেশেও আমদানিতে শুল্ক রয়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। এত শুল্কের বেড়াজালে অতিরিক্ত দাম দিয়ে কেউ আমদানি করবে না।

সরকারি মজুত

বেসরকারি মজুতের পাশাপাশি সরকারের মজুতও ভালো। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সরকারের কাছে বর্তমানে চালের মজুত রয়েছে ১৫ লাখ ৪৭ হাজার ২৩৩ টন ও ধানের মজুত রয়েছে ৬৬ হাজার ৫২৫ টন।
খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ভারতের শুল্ক আরোপে বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তবে বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না।

সরকার ও ব্যবসায়ীদের মতামতকে সমর্থন করে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, কিছু করপোরেট গ্রুপ ও বড় ব্যবসায়ী চালের বাজারে প্রবেশ করে মজুত করে রাখে। খাদ্য বিভাগ মজুতের পরিসংখ্যান রাখলে এবং তা নিয়মিত নজরদারি করলে সরবরাহ লাইনে সংকট হবে না।

উৎপাদন পরিস্থিতি

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে উৎপাদিত মোট ধানের প্রায় ৬০ ভাগ আসে বোরো থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৪ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১ লাখ টন চাল। আমনের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ টন।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জানান, দেশের অন্যতম বৃহৎ চাল মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। চালকল মালিকরা বলছেন, দেশে এই মুহূর্তে যে পরিমাণ ধান ও চাল আছে, তাতে করে আমদানির দরকার হবে না। এগ্রো ফুড মিলের মালিক তোফাজ্জেল হোসেন বেপারি বলেন, এখন আউশ ধান কাটার মৌসুম চলছে। দেশে আউশের আবাদ আগের চেয়ে বেড়েছে। বর্তমানে প্রচুর ধান ও চাল মজুত আছে। চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, চাল নিয়ে বৈশ্বিক রাজনীতি চলছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মজুত অনেক বেশি থাকায় সংকট হওয়ার শঙ্কা নেই।

জসিম উদ্দিন বাদল

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.