নিষিদ্ধ হচ্ছে এক দিনের মুরগির বাচ্চা আমদানি, কার লাভ?

0
239
দেশের বাজারে এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম সব সময়ই টালমাটাল থাকে

দেশে এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার উৎপাদন ও বিপণনের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি খাত। চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এক দিন বয়সী প্রতিটি মুরগির বাচ্চা বিক্রি করেছে ৮০ থেকে ৯০ টাকায়। এখন সেই মুরগির বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৩৯ টাকায়। তবে সরকারি খামারে এসব বাচ্চা বিক্রি করা হয় ১৫ টাকা করে।

দেশের বাজারে এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম সব সময়ই এমন টালমাটাল থাকে। কখনো কখনো খামারিদের প্রতিটি বাচ্চা কিনতে ১০০ টাকারও বেশি গুনতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিকভাবে পালনের জন্য এক দিনের মুরগির বাচ্চা আমদানি নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে জাতীয় পোলট্রি উন্নয়ন নীতিমালা ২০০৮-এ সংশোধনী আনা হচ্ছে।

তবে প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, এখনই দেশের হাতে গোনা কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদনের প্রায় পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি তারা মুরগি পালনও করে থাকে। ফলে এক দিনের বাচ্চা আমদানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে এই খাত তাদের হাতে আরও জিম্মি হয়ে পড়বে বলে খামারিদের আশঙ্কা।

মুরগির বাচ্চা দেশের হাতে গোনা কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। তারা বাচ্চার দাম যখন খুশি বাড়িয়ে দেয়, যখন খুশি কমিয়ে দেয়। কমিয়ে দেয় তখনই, যখন বাচ্চা নেন না খামারিরা। খামারিদের কাছে বাচ্চার চাহিদা থাকলেই বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।সুমন হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন

যেভাবে বাড়ে উৎপাদন খরচ

সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে সারা দেশে ২৮টি মুরগির খামার রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি খামারে মুরগির বাচ্চা (কালার্ড বার্ড) উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ সোনালি, ফাওমি ও আরআইআর জাতের বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। তবে সরকারের এসব খামারে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয় না। ফলে ব্রয়লার মুরগি পালনকারী খামারিদের কোনো কাজে আসে না সরকারের এসব খামার।

ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত—এক বছরে দেশের শীর্ষ ২০টি প্রতিষ্ঠান ১ কোটি ৩৫ লাখটি এক দিন বয়সী বাচ্চা উৎপাদন করেছে। সেখানে এক দিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির কোনো বাচ্চাই উৎপাদন করেনি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মুরগির খামারগুলো।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার খামারি মিঠুন দাস বলেন, ‘চলতি বছরের শুরুর দিকে ৮০ থেকে ৯০ টাকায় এক দিনের মুরগির বাচ্চা কিনতে বাধ্য হয়েছি। এখন সেটা ৩৮ থেকে ৩৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম বেশি হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, ফলে লোকসানে পড়তে হয়।’

বাচ্চা আমদানির সুযোগ রাখার দাবি

এক দিনের বাচ্চা আমদানি নিষিদ্ধের যে উদ্যোগ সরকার নিতে যাচ্ছে, তা সঠিক আছে বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘নীতিমালায় এক দিনের বাচ্চা আমদানি নিষিদ্ধের যে বিষয়টি সংযোজন করতে যাচ্ছে, তা যথার্থ। কারণ, দেশেই এখন বিশ্বমানের অসংখ্য ব্রিডার ফার্ম রয়েছে, যারা বাচ্চার চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাণিজ্যিকভাবে পালনের জন্য বিদেশ থেকে এক দিনের বাচ্চা আমদানি না করাই সমীচীন।’

মোহাম্মদ রেয়াজুল হক আরও বলেন, যদি এক দিনের মুরগির বাচ্চা আমদানি করা হয়, তাহলে স্থানীয় উৎপাদনকারীরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। তা ছাড়া দেশে পোলট্রি খাতে যত রোগ এসেছে, তা আমদানির মাধ্যমেই এসেছে।

বাচ্চা আমদানি নিষিদ্ধের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশও (বিএবি)। বিএবির সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দেশে প্রতি সপ্তাহে বাচ্চার যে চাহিদা, তার চেয়ে ৫০ লাখ পিস বেশি বাচ্চা উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের আছে। আমদানি হলে আমাদের শিল্পের জন্য তা আরও ক্ষতি হবে।’

সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীনে সারা দেশে ২৮টি মুরগির খামার রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি খামারে মুরগির বাচ্চা (কালার্ড বার্ড) উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ সোনালি, ফাওমি ও আরআইআর জাতের বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। তবে সরকারের এসব খামারে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয় না। ফলে ব্রয়লার মুরগি পালনকারী খামারিদের কোনো কাজে আসে না সরকারের এসব খামার।

তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বিএপির সঙ্গে একমত নন প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি মনে করেন, এক দিনের মুরগির বাচ্চা আমদানি নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না।

সুমন হাওলাদার বলেন, মুরগির বাচ্চা দেশের হাতে গোনা কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। তারা বাচ্চার দাম যখন খুশি বাড়িয়ে দেয়, যখন খুশি কমিয়ে দেয়।

কমিয়ে দেয় তখনই, যখন বাচ্চা নেন না খামারিরা। খামারিদের কাছে বাচ্চার চাহিদা থাকলেই বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারের নতুন এই সিদ্ধান্তে তাদের হাতে ক্ষুদ্র খামারিরা আরও জিম্মি হয়ে পড়বে। তাই বাচ্চা আমদানির সুযোগ রাখতে হবে।

নীতিমালায় এমন কিছু থাকতে হবে, যেন মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাচ্চা বাজারে আসবে। আবার বাচ্চার দাম যেন ১০ বা ১২ টাকা না হয়, আবার ৯০ বা ১০০ টাকা না হয়।সাচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী, ইউজিসি অধ্যাপক, পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

মান ঠিক ও দাম স্থিতিশীল রাখার তাগিদ

জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর যাচাই-বাছাই শেষে গত জুনে সংশোধনীর জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় পোলট্রি উন্নয়ন নীতিমালা ২০০৮ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেই সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে মন্ত্রণালয় অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে।

নীতিমালার এই সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্রয়লার, সোনালি বা অন্য কোনো মুরগির এক দিনের বাচ্চা আমদানি করা যাবে না। কেবল এক দিন বয়সী গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক ও ক্ষেত্রবিশেষে প্যারেন্ট স্টক (বিশুদ্ধ জাত) আমদানি করা যাবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক সাচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী মনে করেন, দেশে এক দিনের বাচ্চার মান ঠিক থাকলে এবং দাম স্থিতিশীল থাকলে আমদানি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু বাচ্চার মানও ঠিক নেই এবং দামও অস্থিতিশীল। তিনি বলেন, দেশে উৎপাদিত এক দিনের মুরগির বাচ্চার মান বিভিন্ন রকম হয়। কিন্তু বাচ্চার মান কখনো হয় ভালো, কখনো মধ্যম, কখনো হয় খারাপ। আবার এক দিনের বাচ্চার দাম কমে ১০ টাকায় চলে আসে, আবার দেখা যায়, ৯০ থেকে ১০০ টাকা হয়ে যায়।

এই খাত খুবই অস্থিতিশীল উল্লেখ করে সাচ্চিদানন্দ দাস চৌধুরী বলেন, নীতিমালায় এমন কিছু থাকতে হবে, যেন মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাচ্চা বাজারে আসবে। আবার বাচ্চার দাম যেন ১০ বা ১২ টাকা না হয়, আবার ৯০ বা ১০০ টাকা না হয়। এর জন্য নীতিমালায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন।

চাহিদা বাড়লে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুরগির বাচ্চার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেয়—এমন অভিযোগ পুরোনো। প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, বিকল্প না থাকায় তাঁরা বেশি দামে মুরগির বাচ্চা কিনতে বাধ্য হন। এরপর লোকসান খেয়ে অনেকেই খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

এতে বাজারে মুরগির মাংস ও ডিমের সংকট দেখা দেয়, দাম বেড়ে যায়। তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুরগি ও ডিম বাজারে ছাড়ে এবং বড় অঙ্কের মুনাফা ঘরে তোলে।

প্রদীপ সরকার

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.