দুঃখ, কষ্ট আর বেদনার গানগুলোই যেন তাঁর গলায় খুলত বেশি। ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’, ‘নীল বেদনা’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘রুপালি গিটার’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’ গানগুলোর সুর ও গায়কি থেকে অভিমান যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ত! তাহলে কি মানুষটার মনে অনেক দুঃখ ছিল? বিভিন্ন আড্ডায়, বৈঠকে, আলাপে আইয়ুব বাচ্চু তাঁর কিছু কষ্টের কথা বলেছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরে মাত্র ছাপ্পান্ন বছরের সময় হাতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। আজ ১৬ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে তাঁর সেসব জানা–অজানা কষ্টের কথা শুনি।
‘যখন আমার কষ্টগুলো/ প্রজাপতির মতো উড়ে/ বিষাদের সব কটা ফুল/ চুপচাপ ঝরে পড়ে/ আমার আকাশজুড়ে মেঘ/ ভরে গেছে ভুলে/…আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’—নিজের গাওয়া জনপ্রিয় একটি গানে এ কথাগুলো আছে। গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা গানটিতে যেন মানুষটির ভেতরের কথাগুলোই সুরে সুরে বেরিয়ে এসেছে। ১৯৯৮ সাল থেকে এই গায়ককে কাছাকাছি দেখা, জানার সুযোগ হয়েছিল।
সেই দিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর মারা গেছেন তাঁর মা। জানাজার জন্য মায়ের মরদেহ পল্টনের বাসা থেকে স্থানীয় মসজিদে নেওয়া হবে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম। সেদিন আইয়ুব বাচ্চু মায়ের শূন্য খাটে ঝাঁপিয়ে পড়ে হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন, ‘মা রে, ও মা, মা!’ সেই কান্না, আর্তনাদ এখনো যেন শুনতে পাই।
আইয়ুব বাচ্চু তখন থাকতেন মগবাজারের বাসায়। মা পল্টনের বাসায়। প্রায় প্রতিদিনই মাকে দেখতে যেতেন। শেষ দিকে তাঁর মায়ের কঠিন একটা রোগ ধরা পড়ে। খবরটা শুনে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। মায়ের চলে যাওয়াটাই আইয়ুব বাচ্চুর জন্য সবচেয়ে বড় বেদনার ছিল। বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ‘ভালো হতো, মায়ের আগে যদি আমি যেতে পারতাম…মা যতটুকু সহ্য করতে পারত, আমি তা পারছি না!’ কথায় কথায় বারবার বলেছিলেন, মা তাঁদের জন্য কতটা সংগ্রাম করেছেন, নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাইয়েছেন। মায়ের কথা বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলতেন।
চট্টগ্রামে একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। মনমানসিকতা সে রকমই তৈরি হয়েছিল। এমনটাই থাকতে পছন্দ করতেন। তবে শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারেননি। ছোট হতে হতে একক পরিবার হয়ে যায়। এটাও তাঁকে তিলে তিলে কষ্ট দিত। আর শেষ দিকে সন্তানেরা দেশের বাইরে লেখাপড়া করতে গেলে পুরোপুরি একা হয়ে পড়েন। একান্নবর্তী পরিবার খুব মিস করতেন, কাঁদতেন সেসব কথা বলে। তাঁর মতে, সবাই মিলে একসঙ্গে থাকা, এক টেবিলে খাওয়ার মতো আনন্দ আর নেই।
নিজের গড়া ব্যান্ড এলআরবিতে ২৫ বছর, তার আগে অন্য যেসব ব্যান্ডে ছিলেন, সব কটি থেকেই তাঁকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সর্বশেষ এলআরবির আগে ছিলেন সোলসে। শেষমেশ ছেড়েছিলেন অভিমান নিয়ে। সেই সময়ের গল্পটি গীতিকার শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কাছ থেকে শোনা। তিনি বলেন, ‘সোলস তখন তুঙ্গে, হোটেল ব্লু নাইলে সোলসের সভা চলছে। একসময় দেখলাম মন খারাপ করে বাচ্চু বেরিয়ে এল। চোখ ছলছল। আমার সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা। বলল, “ভাই, সোলস ছেড়ে দিলাম। সোলস থেকে ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’ গানটি চেয়ে নিয়েছি।”’ পরে অবশ্য সোলসের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ঘুচে যায়।
আইয়ুব বাচ্চু সব সময় বলতেন, ‘গিটার আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা।’ বলতেন, ‘আমি গিটারের জন্যই ঘর ছেড়েছি।’ নামীদামি সব ব্র্যান্ডের গিটার সংগ্রহ ছিল তাঁর নেশা। বিদেশে যখনই যেতেন, গিটারের দোকানে যেতেন। বাজাতেন, কিনতেন। সেগুলো নিয়ে নিত্যদিন ভক্ত, বন্ধু, শিল্পীদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতেন। প্রিয় এই গিটারগুলোই জীবনের শেষ দিকে এসে আক্ষেপে-অভিমানে বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ‘আমার ভীষণ ইচ্ছা ছিল, গিটারগুলোসহ বাজিয়েদের নিয়ে দেশব্যাপী একটি গিটার প্রতিযোগিতা করব, যেখানে এই গিটারগুলো বাজিয়ে বিজয়ীরা জিতে নেবে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় একেকটি গিটার! কিন্তু চেষ্টা করেও কোনো পৃষ্ঠপোষকই পেলাম না। গিটারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ বেশ কষ্টকর। তাই ঠিক করেছি, প্রথম দিকে পাঁচটি গিটার বিক্রি করে দেব তাদের কাছে, যারা গিটার বাজায় কিংবা যারা আমার গিটারগুলো সংরক্ষণে রাখতে চায়।’ পরে অবশ্য তাঁকে আর গিটারগুলো বিক্রি করতে হয়নি।
অনেক শিল্পীর বিপদে এগিয়ে যেতেন। মনে আছে, একবার শিল্পী কাঙালিনী সুফিয়ার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেখানে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেছিলেন সুফিয়া। পরদিন নিজে গাড়ি নিয়ে চলে যান কাঙালিনী সুফিয়ার গ্রামে। কাঙালিনী সুফিয়াকে জড়িয়ে সেদিন কেঁদেছিলেন। অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
অসহায় মানুষের জন্য একবুক মায়া ছিল তাঁর। ২০১৪ সালের ঘটনা। নেত্রকোনার কৃষ্ণপুর বড়বাড়ির আড়াই বছরের ছেলে আয়ান ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসার জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রয়োজন। ফেসবুকে সে খবর পেয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজ উদ্যোগে হাসপাতালে চলে যান আইয়ুব বাচ্চু। আয়ানকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর আগে সেখানে যান তিনি। আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দু-তিনবার বললেন, ‘আয়ান বাবুটা, সোনামণিটা, আল্লাহ তোমাকে ভালো করে দেবেন, সুস্থ করে দেবেন।’ কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। তাঁর কান্না দেখে আমরাও কেঁদে ফেললাম। পরে সেখান থেকে হাসপাতালের বিশাল অঙ্কের পাওনা চুকিয়ে ফিরে যান আইয়ুব বাচ্চু।
পপ তারকা আজম খানের সঙ্গে তাঁর ভালো সখ্য ছিল। নানাভাবে তাঁর পাশে ছিলেন, গুরু বলে ডাকতেন। গুরু হিসেবেই মানতেন। সময়–অসময়ে তাঁকে দেখতে ছুটে যেতেন। আজম খানের সংকটে তাঁর পাশে ছিলেন। মৃত্যুর পর এক অনুষ্ঠানে আজম খানের ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না’ গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলেন।
নিজে যেমন বিভিন্ন সময়ে নানান ব্যান্ডের সঙ্গে জড়িয়েছেন, তেমনি এলআরবি গঠনের পর সেটাকেই একটা পরিবারের মতো গড়ে তুলেছিলেন। বলতেন, ‘এটা আমার আরেকটা পরিবার।’ এই প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ২০০৩ সালে বলেছিলেন, ‘আমরা বুড়ো হয়ে গেলে আমাদের সন্তানেরা এলআরবির হাল ধরবে।’ কিন্তু একসময় দেখা গেল, এই দল থেকেও কয়েকজন সদস্য বেরিয়ে গেছেন। কেউ কেউ বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন। অনিয়ম, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণেও কেউ কেউ দলে থাকতে পারলেন না। একসময় দীর্ঘদিনের সঙ্গী কি-বোর্ডিস্ট এস আই টুটুল দল থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চুকে আহত করেছিল। ওই সময়ে মগবাজারে এলআরবির স্টুডিওতে এক চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে আলাপে টুটুলের প্রসঙ্গ উঠলে আইয়ুব বাচ্চু কেঁদে ফেলেন। টুটুলের পর এলআরবি ব্যান্ডে আর কোনো কি-বোর্ডিস্ট নেননি তিনি।
আসলে ‘কষ্ট’ গানের মানুষটার মনে অনেক কষ্ট ছিল। ভেতরে পুষে রাখতেন। একা একা কাঁদতেন। ভেতরে-ভেতরে অভিমান পুষে রাখতেন। এমনও হয়েছে, তিনি কারও আচরণে কষ্ট পেয়েছেন। বলতেন না। মোবাইল ফোনবুক থেকে নম্বরটা ডিলিট করে দিতেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতেন। দেখা হলে হয়তো স্মিত হাসি দিয়ে হালকা কুশল বিনিময় করতেন। কিন্তু বলতেন না কিছুই। আবার হঠাৎ একদিন দেখা গেল, নিজেই ফোন করে তাঁকে খুঁজছেন। দেখা করে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন।
২০১৬ সালের এলআরবির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বেশ আবেগপ্রবণ ছিলেন। সমসাময়িক অনেকে সেদিন যাননি বা যেতে পারেননি। আবার নিজে ফোন করে বলেননি। তাঁর যুক্তি ছিল, নিজের সহশিল্পী, বন্ধুদের কেন বলতে হবে। বন্ধুর বিশেষ দিনে তো বন্ধু এমনিতেই আসবেন।
তাঁর ভেতর যে অনেক কষ্ট, সেটা মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও টের পাওয়া যেত। এমনও দেখা গেছে, আড্ডা হচ্ছে, হঠাৎ ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করে দিলেন আইয়ুব বাচ্চু। শিশুর মতো। অল্পতে খুশি, অল্পতেই মন খারাপ। ১৬ আগস্ট জন্মদিনে ফেসবুকে সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘এক জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়া থাকতে পারে আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের।’ কিছুদিন পর ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘চিন্তার কোনো কারণ নেই। এই পৃথিবী থেকে কেউ জীবিত ফিরে যাবে না।’ আরেকটি স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, ‘আসলে জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না।’ তারপর যেন অভিমান করেই তিনি হঠাৎ চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ হওয়ার নয়।