মোংলা বন্দর দিয়ে দেশের দুই–তৃতীয়াংশ এলপিজি আমদানি হয়। এ ব্যবসায় নিয়োজিত বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এ বন্দরের পাশে নিজস্ব প্ল্যান্ট করেছে।
নোঙর করা বিদেশি জাহাজ থেকে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে জেটি হয়ে কোম্পানির বিশাল ডিমাকৃতির বয়লারে এলপিজি সরবরাহ করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই বয়লার থেকে চিকন পাইপের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাসাবাড়িতে ব্যবহার্য সিলিন্ডারে
গ্যাস ঢুকে যাচ্ছে। এভাবে প্রতি মিনিটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২৬টি সিলিন্ডারে লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ভরা হচ্ছে। এরপর এলপিজিভর্তি সিলিন্ডারগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন ২৬টি সিলিন্ডার বেল্টে ঢুকছে। সেগুলোও গ্যাসভর্তি হয়ে বেরিয়ে আসছে। বের হয়ে আসা এসব সিলিন্ডার ট্রাকে করে সারা দেশে পরিবেশকদের কাছে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি মোংলার ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের প্ল্যান্টে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, তাদের দুটি বিশাল ডিমাকৃতির বয়লারে তিন হাজার টন এলপিজি সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার সিলিন্ডারে গ্যাস পরিপূর্ণ করা সম্ভব। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে মোংলা বন্দর শিল্প এলাকায় আট একর জমিতে এই বড় এলপিজি প্ল্যান্টের যাত্রা শুরু হয়।
এ বিষয়ে ওরিয়ন প্ল্যান্টের একজন কর্মকর্তা জানান, জাহাজ থেকে এলপিজি খালাসের জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জেটি আছে। শুল্কায়নসহ অন্য সব আনুষ্ঠানিকতা সেখানেই সারতে হয়। এর ফলে দ্রুত জাহাজ থেকে গ্যাস খালাস করে তা সিলিন্ডারে ভরে দেশের সব অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু ওরিয়ন নয়, দেশের প্রায় সব বড় এলপিজি কোম্পানিরই মোংলা শিল্প এলাকায় প্ল্যান্ট বা কারখানা আছে। প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব জেটি ও প্ল্যান্ট রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫টির মতো প্ল্যান্ট আছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নাভানা, পেট্রোম্যাক্স, বসুন্ধরা, ওমেরা, যমুনা, ডেলটা গ্যাস, দুবাই–বাংলা, লাফগ্যাস ও সেনাগ্যাস।
সরেজমিনে দেখা যায়, মোংলা বন্দর এলাকার আগে সড়কের পাশে পশুর নদের তীরে দুই কিলোমিটারজুড়ে এসব এলপিজি গ্যাস প্ল্যান্টের অবস্থান। প্রতিটি শিল্প প্লটের আকার ছয় থেকে আট একর। দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যারা এলপিজি ব্যবসায়ে নেমেছে, তাদের প্রায় সবাই এখানে এলপিজি কারখানা স্থাপন করেছে। গত সাত–আট বছরে মোংলা বন্দর এলাকায় এ খাতে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে।
জানা গেছে, মোংলা বন্দর দিয়ে এলপিজিবাহী ছোট জাহাজ আনা বেশ সহজ। এখানে প্রতিটি প্ল্যান্টের নিজস্ব জেটি থাকায় সরাসরি প্ল্যান্টেই এলপিজি সরবরাহ করা যায়। এ জন্যই ব্যবসায়ীরা মোংলা এলাকায় প্ল্যান্ট স্থাপনে বিনিয়োগ করেছেন। ফলে এই দুই কিলোমিটার সড়কের পাশে ডিমাকৃতির বিশাল বিশাল বয়লার চোখে পড়ে। এ যেন গ্যাসের শিল্পনগরী। কারখানার কর্মকর্তা ও স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই বলেন, মোংলা এখন দেশের এলপিজির রাজধানী হয়ে গেছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর ১৫ লাখ টনের মতো এলপিজি আমদানি হয়। এর দুই–তৃতীয়াংশই আমদানি হয় মোংলা বন্দর দিয়ে। দেশে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরব থেকেই এলপিজি আমদানি করা হয়।
মোংলা শিল্প এলাকায় এলপিজি প্ল্যান্ট ছাড়াও তিন–চারটি সিমেন্ট কারখানা আছে।
আমরা রান্নাবান্নার জন্য বোতলজাত লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করি। ইদানীং শিল্পকারখানায়ও এই গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে।
৪০ শতাংশ জাহাজ এলপিজিবাহী
মোংলা বন্দর সচল রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে এলপিজি আমদানি। কারণ, এখানে বর্তমানে যত জাহাজ ভেড়ে, তার ৪০ শতাংশের বেশি এলপিজিবাহী। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত ২০২২–২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৮২৭টি জাহাজ এখানে এসেছে। এর মধ্যে ৩৬৩টি জাহাজে এলপিজি আনা হয়েছে। এসব জাহাজে মোট ৯ লাখ ২৩ হাজার ৬৭ টন এলপিজি আমদানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে ৩২৯টি জাহাজে ৯ লাখ ৩২ হাজার ৪০৬ টন এলপিজি আমদানি হয়েছিল। সাত বছর আগে পেট্রোম্যাক্স গ্যাস কোম্পানি প্রথমবারের মতো মোংলা বন্দর দিয়ে প্রথম এলপিজি আমদানি করে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মোংলায় যেহেতু বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না, তাই ছোট ছোট জাহাজে পণ্য আমদানির সুযোগ বাড়ানো উচিত। এ ক্ষেত্রে মোংলা দিয়ে এলপিজি আমদানি ও প্ল্যান্ট স্থাপন একটি উদাহরণ। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমবে। মোংলাকে চট্টগ্রামের বিকল্প হিসেবে ভাবা উচিত।
শিল্পমালিকেরা জমি কিনে রাখছেন
বাগেরহাটের রামপাল থেকে মোংলা বন্দর পর্যন্ত ১৫–২০ কিলোমিটার সড়কের পাশে অনেক শিল্পমালিক জমি কিনে রেখেছেন। একসময়ের চিংড়িঘেরগুলো ভরাট করে এখন শিল্প প্লট বানানো হচ্ছে। যেমন দিগরাজ এলাকায় মূল সড়কের পাশে উত্তরা মোটরসের কয়েক একর জমি আছে। বড় সাইনবোর্ড ঝুলছে তাদের। ওই এলাকায় ক্রাউন প্যালেস হোটেলের জমির সাইনবোর্ডও চোখে পড়ল।
রামপালের টেংরামারি এলাকায় বিশাল জলাশয়ের ওপর ঝুলছে ফ্রেশ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সাইনবোর্ড। ১০–১২ একর জমি আছে সেখানে। পাশেই ডেল্টা গ্রুপের একটি সিলিন্ডার বানানোর বিশাল কারখানাও আছে।
রামপালের তেঁতুলিয়া সেতু এলাকায় ইজিবাইকের সংযোজন শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ–চীনের যৌথ বিনিয়োগে ডয়েডো মোটরসের কারখানা এটি। সেতু থেকে কিছু দূর এগোলেই চোখে পড়ে ক্রিসেন্ট জুট মিল ও শীতল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্লট।
মোংলা বন্দর ও রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ওই অঞ্চলে শিল্পমালিকদের আগ্রহ বেড়েছে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে এখনই জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক চিংড়িঘের ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অনেক জায়গায় জমি ভাড়া দেওয়ার সাইনবোর্ডও ঝুলছে। ফয়লা এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আবুল কাশেম মিয়া জানান, আগে এই এলাকায় চিংড়িঘেরই ছিল প্রধান আয়ের উৎস। কিন্তু লোনাপানির প্রবাহ বেড়ে যাওয়া, ব্যবসায় মন্দা থাকাসহ বিভিন্ন কারণে অনেকেই এখন জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন, বড় ব্যবসায়ীরা তা কিনে নিচ্ছেন।