চ্যাটজিপিটি নয়, বর্তমান বিশ্বে এআইয়ের ক্রমবর্ধমানভাবে এগিয়ে চলেছে। চ্যাটজিপিটি নিয়ে বিশ্বে একধরনের উন্মাদনা চলছে। প্রতিদিনের আলোচনাতে একবার হলে উঠে আসে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স–এআই ও চ্যাটজিপিটির নাম। দিন দিন বাড়ছে চ্যাটজিপিটির ব্যবহার। মুহূর্তেই উত্তর দিতে পারছে নানা প্রশ্নের উত্তর। চটজলদি সিভি তৈরি করা থেকে কবিতা, গল্প লিখে দিচ্ছে এ প্রযুক্তি। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা গুগল সার্চে যাই, সেগুলোরই আরও সহজ ও তথ্যসমৃদ্ধ উত্তর দিয়ে দিচ্ছে চ্যাটজিপিটি।
বর্তমানে শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাড়ির কাজ শেষ করতে, অ্যাসাইনমেন্ট করতে এবং পরীক্ষার জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করছে। এ কারণে, ভারতে সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেরকেন্ডারি এডুকেশনসহ (সিবিএসই) কয়েকটি বোর্ড, অনেক পাবলিক স্কুল এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তবে এরপরই চ্যাটজিপিটিকে ভবিষ্যৎ হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় বা শিক্ষা খাতে চ্যাটজিপিটির মতো এইআই টুল ব্যবহার করা উচিত, না এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত, তা নিয়ে এক আলোচনা হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া টুডে এডুকেশন কনক্লেভ’ শিরোনামের এক অনুষ্ঠানের ওই আলোচনায় শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চার বিশেষজ্ঞরা সেই আলোচনা করেছেন।
ভারতের শিক্ষাবিদ ও লেখক আভা অ্যাডামস দুটি বিষয়ে তার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, চ্যাটজিপিটির মতো টুলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য সংক্ষিপ্ততম (শর্টকাট) পথের মতো। দ্বিতীয়ত, এটি শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে রাখে বা বিরত রাখে।
চ্যাটজিপিটির মতো টুলের সাহায্যে নিতে থাকলে শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে এবং সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারাতে পারে। যদিও তারা প্রশ্ন তৈরি করা এবং কি–ওয়ার্ড শনাক্ত করার মতো অন্য দক্ষতাগুলো কিন্তু অর্জন করবে। কিন্তু তারা তাদের সৃজনশীলতা এবং লেখার ক্ষেত্রে নিজের থেকে আসা শব্দ-বাক্যের ব্যবহার কমে যেতে পারে। আসলে এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থীরা রোবোটিকের মতো হয়ে যাবে।
আভা অ্যাডামস আরও জোর দিয়ে বলেছেন, এ জাতীয় সরঞ্জামগুলো শিক্ষকদের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে আস্থার ঘাটতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষকেরা প্রশ্ন করতে পারেন যে একজন শিক্ষার্থী কাজটি প্রকৃতপক্ষে নিজে করেছে না এআই ব্যবহার করে তৈরি করে।
তবে, বসন্ত ভ্যালি স্কুলের অধ্যক্ষ রেখা কৃষ্ণানের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভিন্ন। আভা অ্যাডামসের মন্তব্যে পাল্টায় এই অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমি মনে করি না, আভা যে বিশ্বাসের ঘাটতির কথা বলছেন, সেটা সব সময়ই আছে। কিন্তু এটা ঠিক, দিন দিন সেটা বাড়ছে।’
রেখা কৃষ্ণান নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থীর ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছেন। তিনি দেখেছেন তাদের প্রায় ৭০ শতাংশ নিজের অ্যাসাইনমেন্টের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি জানেন না, যে তারা কীভাবে ডেটা সংগ্রহ করেছে। প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী চায় যে শেখার প্রক্রিয়ায় স্কুলে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা উচিত। আর ৪০ শতাংশ শিক্ষক এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
রেখা কৃষ্ণান বলেন, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষাদান এবং শেখার জন্য বিশ্বাস থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করেন, চ্যাটজিপিটি মডেলের মাধ্যমে, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মধ্যে এখনো বিশ্বাস তৈরি করা যেতে পারে। স্মার্ট শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষে চ্যাটজিপিটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারেন, অন্যরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারেন।
বসন্ত ভ্যালি স্কুলের অধ্যক্ষ রেখা বলেন, ‘আমরা বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যেতে পারি না। চ্যাটজিপিটি হলো বাস্তবতা। একজন শিক্ষক হিসেবে, আমাদের মডেলটিকে স্মার্টভাবে ব্যবহার করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার চেয়ে বড় হলো শিক্ষা এবং শেখার বিষয়টি। আমরা কি শিক্ষার্থীদের শুধু পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছি? উত্তরটি হচ্ছে না। আমরা চাই, তারা জীবনে এবং স্কুলের বাইরেও সফল হোক। আসছে দিনে শিক্ষার্থীদের এআই পরিবেষ্টিত হয়ে জীবন চলতে হবে। তাদের এটির সঙ্গে এবং কখনো কখনো এর বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। তাই চ্যাটজিপিটি বুঝতে হবে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত হবে, তাদের স্কুল, কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ মডেলের সঙ্গে কাজ করতে সহায়তা করা।’
একইভাবে, টোয়েন্টিওয়ান কে স্কুলের সিইও এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা সন্তোষ কুমার বলেছেন, চ্যাটজিপিটির মতো টুলসগুলো শিক্ষার্থীদের উচ্চস্তরে চিন্তা করতে সক্ষম করে গড়ে তুলছে। তিনিও চান শিক্ষার্থীদের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হোক। কারণ, এটি শেখার এবং দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটি দুর্দান্ত পদ্ধতি। এটি থেকে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েই উপকৃত হতে পারে।
কোর্সেরার পরিচালক প্রশাস্তি রাস্তোগিও শিক্ষার্থীদের জন্য এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চ্যাটজিপিটি ব্যবহারকে সমর্থন করেন। শিক্ষা খাতকে এ প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বিকশিত হতে হবে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে বিপুলসংখ্যক সংস্থা এআই পরীক্ষামূলক ব্যবহার করছে। এতে তারাও বিনিয়োগ করছে। অনেক কর্মীও এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পেরে খুশি। অতএব, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে, তাদের চ্যাটজিপিটির মতো এইআই টুলস ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া উচিত।
এখন একটি প্রশ্ন উঠছে, ‘এআই কি শিক্ষকদের বদলি হিসেবে কাজ করবে?’ এর জবাবে প্রশাস্তি এবং আভা একমত যে এআইয়ের টুলগুলো জ্ঞান সরবরাহ করতে পারে। তবে সমস্যা সমাধানের মতো দক্ষতা বিকাশের জন্য অপরিহার্য আসলে মানুষই।
আভা একজন শিক্ষকের উদাহরণ দিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়ন করতে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন একজন শিক্ষক। তিনি দেখেছেন এআই প্রযুক্তি সেই শিক্ষকের চেয়ে ভালো মূল্যায়ন করেছে। তবে যা–ই হোক, এআই বা চ্যাটজিপিটি শিক্ষকদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে মানব সংযোগ অত্যাবশ্যক। শিক্ষার্থীদের নানা দক্ষতা বিকাশে শিক্ষকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা এআই চ্যাটজিপিটি করতে পারে না।
আসলে মানব উপাদান অপরিহার্য। শিক্ষকেরা কখনই অপ্রাসঙ্গিক হবেন না। তবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে কার্যকর থাকতে নানা প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে শিক্ষকদের।