মাদকের ছোবলে মেধাবী সন্তান পরিবারের বোঝা

0
214

তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। একমাত্র ছেলেকে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। সেখানে গিয়ে ছেলে হয়ে পড়েছে মাদকাসক্ত। লেখাপড়া শেষ না করেই দেশে ফিরেছে। এখন সে পরিবারের বোঝা। তাঁরা বাস করেন রাজধানীর উত্তরায়। সন্তানকে নিয়ে শুধু এই কর্মকর্তার নয়, অনেক পরিবারের স্বপ্ন চুরমার হয়েছে মাদকের ছোবলে; নিরুপায় অভিভাবকরা কাঁদছেন নীরবে।

রাজধানীর কয়েকটি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে মাদকাসক্তদের সঙ্গে কথা হয়। জানা যায়, অনেক রোগী উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তান। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল করা শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরই মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য পরিবারের উদাসীনতাকেও দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

উত্তরায় ফেয়ার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কথা হয় ওই সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি সচিব ছিলেন। জানালেন, সন্তান মেধাবী হওয়ায় বিদেশে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলেন। ২০০৬ সালে পাঠানো হয় মালয়েশিয়ার একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তে। কিন্তু তার কথা এখন বলতে গেলেই কণ্ঠ শীতল হয়ে আসে। সবার সামনে মাথা নিচু করে কথা বলতে হয় তার। ছয় বছর বিদেশ থেকেছে, দেশ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু কোর্স শেষ করার আগেই মাদক সেবনের দায়ে সে দেশের পুলিশের হাতে আটক হয়। ২০১২ সালে দেশে ফিরেছে। তিনি বলেন, ‘সন্তানকে তো আর ফেলে দিতে পারি না। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করার পর অবস্থার উন্নতি হয়েছে। নিয়মিত এখানে আসতে হয়। পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হলে বোঝা যায়, এর যন্ত্রণা কী!’

ফেয়ার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে বর্তমানে ১৮ রোগী আছেন। এ পর্যন্ত ৭৫০ জন চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়েছেন। এখানে ভালো হওয়া রোগীদের জন্য আলাদা কেন্দ্র আছে। সেখানে বিভিন্ন সময় তাদের সমস্যা নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়।

শ্যামলীতে আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে কথা হয় মাদকাসক্ত দু’জনের সঙ্গে। এক নারীর বয়স ৪২। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে থাকেন মিরপুরে। স্বামী ব্যবসায়ী, তিনিও মাদকাসক্ত। এই নারী বলেন, ‘স্কুলজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম ধূমপানের অভ্যাস হয়। এক বান্ধবী বিষয়টি পরিবারকে জানায়। এতে খুব ঝামেলা হলো পরিবারে। মা-বাবার শাসনে এক রকম ভালোই হয়ে গেলাম। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীকে নেশা করতে দেখি। এক সন্তান হওয়ার পর স্বামীর সঙ্গে নেশায় জড়িয়ে পড়ি।’ ওই নারী আরও বলেন, তিনি কখনও গ্রেপ্তার হননি। তবে তাঁর স্বামী বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। নিরাময় কেন্দ্রে আসার আগে স্বামীর নেশার কথা পুলিশকে জানিয়ে দিলে রাগ করে তাঁকে নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে দেন। নিজেই শপথ করছেন, মাদক আর স্পর্শ করবেন না। স্বামীকেও নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে ঘর মাদকমুক্ত করবেন।

নিরাময় কেন্দ্রের আরেক তরুণী বলেন, তাঁর বাবা ও দুই ভাই থাকেন আমেরিকায়। মা ও ভাবির সঙ্গে তিনি থাকতেন যশোরে। এসএসসি পরীক্ষার পর স্ট্রোক হয় তাঁর। সুস্থ হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরছিলেন। তবে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে সিগারেটসহ নেশা গ্রহণ করতে থাকেন। ওই সময় তাঁর বাবা দেশে আসার পথে বিমানে স্ট্রোক করে মারা যান। এই কষ্ট থেকেই মাদকে বেশি আসক্ত হন। এখন তাঁর মা আমেরিকায় থাকেন। ভাবির সঙ্গে থাকেন তিনি। নিরাময় কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আমেরিকায় চলে যাবেন। বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়তে চান। আহ্ছানিয়া মিশনের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেখানে এ পর্যন্ত ৬৮২ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

এর মধ্যে সুস্থ জীবনে ফিরেছেন ১২৯ জন। দ্বিতীয়বার চিকিৎসা নিয়েছেন ১১০ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৩০। রাজধানীর তেজগাঁও কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ১২৪ বেড আছে। চিকিৎসা নিচ্ছে পাঁচ কিশোর। মাদক সেবনের অভিযোগে বিভিন্ন এলাকা থেকে আটকের পর পুলিশ তাদের এখানে রেখে গেছে বলে জানান এক সেবিকা। এক কিশোরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সে লেগুনাচালকের সহকারী। রাজধানীর চকবাজার এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকে। এর আগেও একবার এই নিরাময় কেন্দ্রে ছিল। আবার মাদক সেবনের কারণে এখানে পাঠানো হয়েছে। বাকি চারজনকে ভোলা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের ৪৫ জেলায় মাদক নিরাময় কেন্দ্র আছে। এর মধ্যে চারটি সরকারি। এগুলোতে ১৯৯ জন চিকিৎসা নিতে পারে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৫৮টি কেন্দ্র আছে। এগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারে চার হাজার ৮৪৬ জন। আহ্ছানিয়া মিশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, মাদকাসক্তের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশই পুরুষ। এর মধ্যে ১৯ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৪৮ শতাংশ; ৩১ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ।

ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী বলেন, ‘আমরা আধুনিক হয়েছি, কিন্তু সচেতন হচ্ছি না। পরিবারের সদস্যদের কাছে ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনীয় সঙ্গ পাচ্ছে না। তাদের নৈতিক শিক্ষা দিতে পারছে না পরিবার। বেসরকারি নিরাময়  কেন্দ্রগুলোতে আসা মাদকাসক্তদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থী।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, মাদকের সহজলভ্যতার কারণে মাদকসেবী বেড়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবনকারী বাড়ছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবার সচ্ছল থাকায় তাদের হাতে নগদ অর্থ বেশি থাকে। এ ছাড়া তাদের তেমন কোনো মনিটরিং ব্যবস্থা থাকে না। তাদের অনেকে সহপাঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাদকে জড়িয়ে পড়ে। বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতেও তাদের সংখ্যা বেশি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো প্রক্টরের তত্ত্বাবধানে থাকে। সেখানে শিক্ষার্থীরা একটা অনিয়ন্ত্রণে থাকে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.