বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছে না সরকার। যে পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে, তার চেয়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হচ্ছে বেশি। এ কারণে ব্যাংকের ওপরই সরকারকে ভর করতে হচ্ছে। চূড়ান্ত হিসাবে সর্বশেষ গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা, যা একক অর্থবছরের রেকর্ড। এ ছাড়া সরকারের ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে, যা মূল্যস্ফীতি উস্কে দেয় বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। এর আগের অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ দেওয়া মানে নতুন টাকা ছাপানোর মতো। এ প্রবণতা সব সময়ই মূল্যস্ফীতি উস্কে দেয়। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ কম নেওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। চলতি বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রকাশনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ কমিয়ে সঞ্চয়পত্রে বাড়ানোর পরামর্শ ছিল।
গত অর্থবছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৪১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ঋণ নেয় সরকার। আর বাংলাদেশ ব্যাংক দেয় ৩১ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত হিসাবে এ উৎস থেকে সরকারের ঋণ ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা ঋণাত্মক। এর মানে সরকার যে পরিমাণ বিনিয়োগ পেয়েছে, তার চেয়ে ওই পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে। জানা গেছে, মেয়াদ পূর্তির আগে অনেকে সঞ্চয়পত্রের নগদায়ন করছেন, যার অন্যতম কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। নতুন অর্থবছরের শুরুতেও ব্যাংক ঋণে নির্ভরতা দেখা যাচ্ছে। গত ৪ জুলাই পর্যন্ত অর্থবছরের মাত্র ৪ দিনে সরকার নিয়েছে ৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এতে সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে বেশিরভাগ জিনিসের দর বেড়েছে। একই সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়নের কারণে কোনো পণ্যের দর একই থাকলেও বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অথচ সরকারের রাজস্ব আয় আশানুরূপভাবে বাড়েনি। গত অর্থবছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যা প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা কম। রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ২২ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৭৪ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অথচ আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা।