আবদুর রাজ্জাক ছিলেন রিকশাচালক। নিজে রিকশা চালালেও ছেলেকে পড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কিছুদিন রিকশা চালিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সংসার ও পড়াশোনার খরচ মেটাতে ইটভাটায় কাজ, বিল থেকে কচুরিপানা সংগ্রহ করে তা বিক্রি করাসহ নানা কাজ করেছেন। এরপর অনলাইনে আম, মধু, গুড় ও গরু বিক্রি করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকের নজর কেড়েছিলেন। তাঁর নাম জুয়েল মামুন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে এবার জুয়েল হয়ে যাচ্ছেন পুলিশের সার্জেন্ট। শিগগিরই এই পদে তিনি যোগ দিচ্ছেন।
গত বুধবার মুঠোফোনে কথা হয় জুয়েলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ৯ জুলাই এক বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশের সার্জেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার খবরটি পেয়েছেন। তখনো তিনি অনলাইনে বিক্রি করা আম কুরিয়ারে পাঠানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
জুয়েল বলেন, ‘নিজে ফলাফল দেখার সাহস পাচ্ছিলাম না। ভয়ে ভয়ে ফল দেখি। দেখলাম তালিকায় আমার নামটাও আছে। সঙ্গে সঙ্গে আম্মাকে ফোন দিই। আম্মা বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিলেন না। পরে কান্নাকাটি শুরু করেন। আব্বারও একই অবস্থা। একটা ভালো চাকরি হোক, তা সবাই চাইছিল।’
জুয়েল বলেন, ‘আমের সময়, তাই ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হচ্ছিল। এর মধ্যেই এই সুখবর পেলাম। ১৬ জুলাই কাজে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
জুয়েলের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রতন বরিষ গ্রামে। তাঁর বাবা আবদুর রাজ্জাক একসময় ঢাকায় রিকশা চালাতেন। জুয়েল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। ছোট ভাই আলমগীর হোসেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি বিভাগে স্নাতকোত্তরে পড়ছেন। একমাত্র বোন পড়ছে সপ্তম শ্রেণিতে।
জুয়েল বলেন, এমনও অনেক দিন গেছে, যখন ঘরে চাল থাকত না, দোকানের বিক্রেতাও বাকিতে জিনিস বিক্রি করতেন না। তখন পরিবারের সবাইকে খাবারের জন্য কষ্ট করতে হয়েছে।
২০১৮ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘ফ্রুট হাট’ নামের একটি পেজ খোলেন জুয়েল ও তাঁর ভাই আলমগীর। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। সব মিলে এখন কেমন আছেন, জানতে চাইলে জুয়েল বলেন, ‘এখন আমরা ভালো আছি।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাবাকে আর রিকশা চালাতে হচ্ছে না। আগে বাড়িতে পানি উঠত। বাড়িটাও কিছুটা মেরামত করতে পেরেছি।’
চলতি বছরে এখন পর্যন্ত অনলাইনে আম বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৩০ টন ছাড়িয়ে গেছে বলে জানালেন জুয়েল। গোয়ালে গরু আছে তিনটি।
পুলিশে নিয়োগ পাওয়ার পেছনে জুয়েল এককভাবে কৃতিত্ব নিতে রাজি নন। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের চন্দ্রনাথ দাদা—সবার অবদানে আজ আমি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। নিজে কোনো কাজকেই ছোট করে দেখিনি, লজ্জা পাইনি। নিজের অবস্থান নিয়েও লজ্জা পাইনি।’
জুয়েল আরও বলেন, ‘আমি শুধু একা পরিশ্রম করিনি। আব্বা রিকশা চালিয়েছেন। আম্মা কচুরিপানা সংগ্রহ করার কাজ করেছেন। ভাই ব্যবসায় সহযোগিতা করেছে। আর মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি অনেক। শিক্ষকেরা বেতন নিতেন না বা দুই ভাই পড়লেও হয়তো এক ভাইয়ের বেতন নিতেন।’
চাকরি পাওয়ায় এখন আর ব্যবসায় সময় দিতে পারবেন না জুয়েল। তিনি বলেন, ব্যবসায় সহযোগিতার জন্য চার থেকে পাঁচজন কর্মী আছেন। ছোট ভাই ব্যবসাটা সামলে নিতে পারবেন।
জুয়েল জানালেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ইটভাটায় কাজ করার মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাত ১০টার পর অল্প কিছুদিন রিকশাও চালিয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর রিকশা চালানোর খবর জানতে পেরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধন করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট চন্দ্রনাথ। তাঁর সহায়তায় ফাউন্ডেশনে বৃত্তির জন্য আবেদন করেন জুয়েল। মাসিক তিন হাজার টাকা করে প্রায় দুই বছর এ বৃত্তি পান জুয়েল।
এরপর ছোট ভাইকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো, ফাউন্ডেশনের বৃত্তির আওতায় আনার ক্ষেত্রেও সার্বিক সহায়তা করেন চন্দ্রনাথ।
চন্দ্রনাথ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। দেশটির মেকার করপোরেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও চিফ টেকনোলজি কর্মকর্তা (সিটিও) তিনি। প্রতিষ্ঠানটি ম্যানুফ্যাকচারিং মনিটরিং সিস্টেম-বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের পারডু ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং স্কলার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জুয়েল পুলিশের সার্জেন্ট হতে যাচ্ছেন—খবরটি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন।
২০২১ সালের ৬ জুন ‘অনলাইনে আম বিক্রি করে রাজশাহীর শিক্ষার্থীদের দিনবদল’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে জুয়েলের জীবনসংগ্রাম তুলে ধরা হয়েছিল।
জুয়েল বলেন, ‘অন্য কাউকে পরামর্শ বা উপদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার জীবনে এ পর্যন্ত আসার পেছনে যে সংগ্রাম ছিল, তা দেখে যে-কেউ উৎসাহিত হতে পারেন। আমি বলব, কোনো কাজকেই ছোট মনে করা উচিত নয়। কাজ নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, চাকরি পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়, দেনদরবার করতে হয় বলে যে অভিযোগ আছে, তাঁর ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি।
বিভিন্ন কাজ ও ব্যবসা করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে জুয়েলের। তাঁর মতে, পুলিশ হিসেবে মানুষকে সেবা দিতে চাইলে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। কথা বলতে হবে। এই দক্ষতা তাঁর আছে। এটা পেশাগত জীবনেও কাজে লাগবে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে সফল হওয়ার ব্যাপারেও বেশ আত্মবিশ্বাসী জুয়েল।