চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা বান্ডেল সেবক কলোনি। দূর থেকে এর প্রবেশপথে ভিড় চোখে পড়ে। একটি ছয়তলা ভবনের বেলকনিগুলো থেকে নিচে উঁকি দিয়ে একনজর দেখছেন বাসিন্দারা। তাদের অনেকেই বিষণ্ণ, কারও চোখে জল। কেউ কেউ অস্ফুট বিলাপ করছেন, যা দূর থেকে দুর্বোধ্য শোনা যাচ্ছে। কলোনির এক চিলতে উঠোনে টেবিলের ওপর রাখা ছয় বছরের হ্যাপি দাশের ছোট্ট দেহ। মিঠুন-আরতি দম্পতির তৃতীয় সন্তান সে। তাকে ঘিরে স্বজন-প্রতিবেশীরা মাতম করছেন; বাকরুদ্ধ তার মা-বাবা। মিঠুন-আরতি দম্পতি ১৯ দিনের ব্যবধানে হারিয়েছেন তিন কন্যাকে।
বান্ডেল কলোনির নিচতলায় ৮০ থেকে ১০০ বর্গফুটের ছোট্ট ঘরে চার কন্যাকে নিয়ে থাকেন মিঠুন দাস ও আরতি দাস দম্পতি। গত ২০ জুন প্রতিদিনের মতো কন্যাদের ঘুমে রেখে কাজে যান সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিঠুন ও আরতি। বড় মেয়েদের বলে যান ছোট মেয়ে ঘুম থেকে উঠলে দুধ গরম করে খাওয়াতে। মেজ মেয়ে সাকসি দাশ ঘুম থেকে উঠে দুধ গরম করে ছোট বোন সুইটি দাসকে খাওয়ায়। চুলা থেকে পাতিল নামালেও চুলা বন্ধ করতে ভুলে যায় সে। ছোট বোনকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে তার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে শিশু সাকসি। এর মধ্যে বড় বোন সারথি ঘুম থেকে উঠে দুধ গরম করতে ম্যাচের কাঠি জ্বালাতেই পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়। এতে তিন বোন দগ্ধ হয়।
ঘটনার তদন্তে থাকা কোতোয়ালি থানা পুলিশের এসআই শামসুল ইসলাম বলেন, ‘ঘরে আগুন ধরে গেলে ছোট বোনকে বাঁচাতে বড় তিন বোন তার শরীরে ওপর উপুড় হয়ে থাকে। এতে তিন বোন দগ্ধ হলেও ছোট বোন বেঁচে যায়।’
আরতির ভাই উত্তম লালা বলেন, ‘বিকট শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হই। দেখি, বোনের ঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তাড়াতাড়ি ভাগ্নিদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। ছোট ভাগ্নিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। মেজ ভাগ্নি সাকসির অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। ঘটনার দু’দিন পর সারথি ও হ্যাপি দাসকে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়।’
স্বজনরা জানান, ২৪ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাকসির মৃত্যু হয়। তখন তার মা বড় ও সেজ মেয়ের সঙ্গে ছিলেন ঢাকায়। শেষবারের মতো মেয়েকে দেখতে তাঁকে চট্টগ্রামে আনা হয়। মেয়ের দাহ শেষে আবার ফিরে যান ঢাকায়। ৩০ জুন বড় মেয়ে সারথি দাস না ফেরার দেশে চলে যায়। তাকে সৎকারের জন্য আসেন চট্টগ্রামে। এবার সেজ মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় তাদের লড়াই, প্রার্থনা। ছোট্ট হ্যাপিও মারা যায়।
এ ঘটনায় বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে বান্ডেল কলোনিতে। বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয় হ্যাপির মরদেহ। তার শেষ যাত্রায় অংশ নিতে প্রতিবেশীর ঢল নামে। ছুটে আসেন জনপ্রতিনিধিরাও।
দেখা হয় মিঠুন দাসের সঙ্গে। উসকোখুসকো চুল। বিধ্বস্ত চেহারা। কথা বলার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কিছুই বলতে পারছেন না। কানে ভাসে মিঠুনের মা মালা রানী দাসের বিলাপ, ‘ঠাকুর এ কেমন তোমার শাস্তি? আমার কলিজার টুকরা তিন নাতনিকে নিয়ে গেলে। আমি এখন কাকে নিয়ে থাকব।’
স্থানীয় কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী বলেন, ‘মর্মান্তিক ঘটনা। একে একে তিন সন্তান হারিয়েছে এ দম্পতি। চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়েও পরিবারটি নিঃস্ব। ইতোমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদের পাশে থাকবে সিটি করপোরেশন।