শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর এক দফার আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত নয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকে সর্বশেষ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত যত আন্দোলন করেছে বিএনপি, সবগুলোই এক দফার ছিল। এটি নতুন কিছু নয়।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে চিন্তিত না হলেও রাজপথের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে যা যা করণীয়, সবই করবে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে বিএনপির ‘তারুণ্যের সমাবেশের’ পাল্টা হিসেবে দেশের আট বিভাগীয় শহরে ছাত্র ও যুব সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। মূলত দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে এসব সমাবেশ করা হবে। এসব কর্মসূচিতে নিজ নিজ বিভাগের মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির ভূমিকা থাকবে। দিন-তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। তবে চলতি মাস থেকেই সমাবেশগুলো শুরুর কথা রয়েছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি যে এক দফা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলছে, তা মাথায় রেখেই এসব সমাবেশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বিএনপি যাতে এককভাবে রাজপথের দখল নিতে না পারে, সেটাই আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য। এ জন্যই ছাত্র ও যুবসমাজের নামে তরুণদের রাজপথে নামানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে বিএনপির চলমান কর্মসূচি দেখে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ভিন্ন কর্মসূচিও নেওয়া হতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, আট বিভাগে সহযোগী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সমাবেশের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে এখনো কর্মসূচি চূড়ান্ত হয়নি। শিগগিরই একটা বৈঠক করে চূড়ান্ত করা হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিএনপি কী করবে, এটা নিয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত নয়। তাদের পুরো মনোযোগ এখন নির্বাচনের দিকে।
আওয়ামী লীগের এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে বরাবরই সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোকেই সামনে রাখা হয়। সহযোগী সংগঠনগুলোর সূত্র বলছে, ‘রাজপথের নিয়ন্ত্রণ যার, রাজনীতি ও ভোটের নিয়ন্ত্রণ তার’—এমনটাই তারা মনে করে। আগে এই কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এবার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সামনে থাকবে। পরে প্রয়োজন হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ভূমিকা পালন করবে।
যুবলীগের একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীরা এক দফার যে আন্দোলনের পরিকল্পনা নিয়েছে, তা মূলত রাজপথ দখলের চেষ্টা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সহযোগী সংগঠনগুলো রাজপথ যেকোনো মূল্যে নিজেদের দখলে রাখবে। এ ক্ষেত্রে সংঘাত হলে কিছু করার নেই।
যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান বলেন, যুবলীগ এখন জেলায় জেলায় সমাবেশ করছে। তাঁরা রাজপথ দখলে রাখবেন।
বিএনপির এক দফার আন্দোলন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন হচ্ছে—এটি নতুন কিছু নয়। কারণ, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যত আন্দোলন করেছে বিএনপি, এর প্রতিটিরই লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনার সরকারের পতন। এমনকি গত ডিসেম্বরে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, এরও মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের পতন ঘটানো। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রাখার কারণে তা পারেনি বিএনপি। আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানোর মতো অবস্থা বিরোধীদের নেই বলেও মনে করছে ক্ষমতাসীন দল।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র বলছে, রাজপথে বিএনপির আন্দোলনের প্রতিটির পাল্টা কর্মসূচি দেবে আওয়ামী লীগ। গত ডিসেম্বর থেকে এভাবে পাল্টাপাল্টি করে দলের পক্ষে ইতিবাচক ফল পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ফলে তা অব্যাহত রাখা হবে। এভাবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে। তখন আর আন্দোলন জমবে না।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটাতে হলে গণ-অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। এর কোনো সম্ভাবনা, লক্ষণ বা ইঙ্গিত তাঁরা দেখছেন না। আর বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিতে পারবে না। জ্বালাও-পোড়াওয়ের পথও বন্ধ। কারণ, এ ধরনের কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো পছন্দ করবে না। বড়জোর বেশি বেশি লোক জমায়েতের চেষ্টা করবে বিএনপি। আওয়ামী লীগও চলতি মাস থেকে বড় বড় জমায়েত করবে। সেপ্টেম্বর থেকে নির্বাচনী জনসভা শুরু করবে ক্ষমতাসীন দলটি।
আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিএনপির এবারের আন্দোলন কর্মসূচি কৌশলী। তবে এগুলো দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করেন।
গতকাল শনিবার ঢাকা উড়ালসড়ক প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেখতে গিয়ে বিমানবন্দর এলাকায় বিএনপির এক দফা আন্দোলন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপিসহ ৩২ দলের জগাখিচুড়ির ঐক্যের এক দফার আন্দোলনের পতন অনিবার্য।’ তিনি আরও বলেন, বিএনপির আন্দোলনের নেতা কে? ক্যাপ্টেন ছাড়া কি জাহাজ চলবে? সরকার যেমন আছে, তেমনই থাকবে।
কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ স্বাভাবিক
বিএনপির আন্দোলনের চেয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতা, মার্কিন ভিসা নীতি, পশ্চিমা আইনপ্রণেতাদের ভূমিকা বেশি ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগকে। ১৫ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বৈঠক হতে পারে। এর আগে মার্কিন কর্মকর্তারা বৈঠক করবেন।
এসব বৈঠকে আওয়ামী লীগ পাঁচ সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়টি তুলে ধরবে। পাশাপাশি আইন প্রণয়ন করে সরকার নির্বাচন কমিশনকে যে শক্তিশালী করেছে, সেই যুক্তিও থাকবে আওয়ামী লীগের।
দলটির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে বিদেশি কূটনৈতিকদের তৎপরতার বিষয়ে কথা হয়। তাঁরা মনে করছেন, ভোটের আগে এই তৎপরতা নতুন নয়। এবার বাড়তি হচ্ছে ভিসা নীতি ও নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা। তবে সরকার নির্বাচন করে ফেলতে পারলে সমস্যা হবে না।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
তিনি গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদল আসছে নির্বাচন–সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে নয়, তারা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি জানতে আসছে। আর ইইউ প্রতিনিধিদল আসছে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল কীভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, তা দেখতে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, তাঁরা বিএনপির আন্দোলনের বিপরীতে কর্মসূচি রাখছেন, একই সঙ্গে মানুষকে নির্বাচনমুখী করার কর্মসূচি নিয়েও এগোনোর পরিকল্পনা নিয়েছেন।