জলবায়ু পরিবর্তনে আফ্রিকায় দল ভারী হচ্ছে জঙ্গিদের

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন

0
158
লেক চাদ এলাকায় সক্রিয় বোকো হারাম জঙ্গিগোষ্ঠী, ফাইল ছবি এএফপি

আফ্রিকার সাহেল এলাকায় ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার কারণে কমছে শস্য উৎপাদন। এ সুযোগে জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারাম সাধারণ মানুষকে উন্নত ভবিষ্যতের প্রলোভন দেখিয়ে দলে ভেড়াচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সহিংস সংঘাত মিলে এই অঞ্চলে মারাত্মক দুষ্টচক্র তৈরি হতে পারে।

বোকো হারামের জঙ্গিরা যখন আলহাদজি ইয়ারোর গ্রাম লেক চাদে তাণ্ডব চালায়, তখন তিনি কিশোর। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, মানুষের দিকে বন্দুক তাক করে জঙ্গিরা তাদের দলে ভেড়ার প্রলোভন দেখিয়ে বলছিল, ‘আমরা তোমাদের উন্নত জীবন দেব।’

ইয়ারো ভয় পেয়েছিলেন, কিছুটা কৌতূহলও ছিল। তিনি বলছিলেন, তিনি প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। এরপর জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে তাঁদের পরিবারের আবাদি জমিতে শস্যের উৎপাদন কমতে থাকে। ২০১৫ সালে বোকো হারামের ওই তাণ্ডবের আগে বন্যায় ভু্ট্টা, বাজরা—সব নষ্ট হয়ে যায়।

গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। বাড়ছে খরা, কমছে বৃষ্টিপাত। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি বোকো হারামের তৎপরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে, জঙ্গিদের সহিংসতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর সাবেক সদস্য, সামরিক কর্মকর্তা ও গবেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আত্মপ্রকাশ করা বোকো হারামের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটা ‘সুযোগ’ এনে দিয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আফ্রিকার এই অঞ্চলের তরুণদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাদের জঙ্গিগোষ্ঠীতে ভেড়ানো সহজ হচ্ছে। চলতি বছর জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বিষয়টি উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়, ধর্মীয় মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নয়, কাজের সুযোগ হিসেবে আফ্রিকাজুড়ে তরুণেরা কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোতে নাম লেখাচ্ছে।

লেক চাদ এলাকার অবস্থানটা এমন যে চাদ, নাইজেরিয়া, ক্যামেরন ও নাইজারের সীমান্ত এখানে এসে মিলিত হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে বোকো হারামসহ অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠী এই এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ডের (আফ্রিকম) সামরিক কর্মকর্তারাও বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব লেক চাদসহ আশপাশের অঞ্চলে ‘হুমকি’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জলবায়ু ও সংঘাতের মধ্যে যোগসূত্রের বিষয়টি তাঁরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।

আফ্রিকায় ফরাসি সামরিক বাহিনীর যত বড় ঘাঁটি আছে, তার একটি চাদে। ফরাসি এক সেনা কর্মকর্তাও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংঘাত বৃদ্ধির ভূমিকার কথা বলে মানছেন।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী যে ২০টি দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে, সেগুলোর অর্ধেকের বেশি দেশে সশস্ত্র সংঘাত চলছে। এই ঝুঁকির তালিকায় চাদ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে।

জার্মানির প্রতিষ্ঠান আডেলফির জলবায়ু কূটনীতি ও নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান জননী বিবেকানন্দ বলেন, ‘এসব সংঘাতের কারণ জলবায়ু পরিবর্তন নয়, কিন্তু সংঘাতের মাত্রাকে তা জটিল করে তুলছে।’

চাদের সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণের পর থেকে একটি ধুলামলিন আশ্রয়শিবিরে আছেন বোকো হারামের সাবেক সদস্য আলহাদজি ইয়ারো। তিনি বলছিলেন, বোকো হারাম যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কিছুই তারা পূরণ করেনি।

রেড জোনের অভ্যন্তরে

প্রায় এক দশক আগে বোকো হারামের যোদ্ধারা লেক চাদে তৎপরতা শুরুর পর বহু মানুষের প্রাণ গেছে। একসঙ্গে পুরো গ্রামের বাসিন্দাদের অপহরণ করেছে তারা। তরুণদের তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাপ দিয়েছে।

লেক চাদের অনেক দ্বীপই এখন ‘বিপজ্জনক অঞ্চল’। সেখানে বোকো হারামের আধিপত্য।

সম্প্রতি লেক চাদের কৌলফৌয়া দ্বীপে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা খেলাধুলা করছে। মাছ বিক্রি করছেন নারীরা। এলাকার প্রধান মাহামাত আলি কোংগোই বললেন, আর্থিক বঞ্চনার কারণে এলাকার অনেক মানুষ কট্টরপন্থীদের দলে ভিড়ছে। এলাকার কিছু ছেলেপুলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছে, কিন্তু কৃষিকাজ বা মাছ ধরা ছাড়া তাদের সামনে কোনো পথ নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৫১ থেকে ১৯৮০ সাল মেয়াদের তুলনায় গত তিন দশকে চাদের গড় তাপমাত্রা ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেড়েছে।

কট্টরপন্থা বেছে নেওয়া

লেক চাদের বালুময় পাড়ঘেঁষে গড়ে উঠেছে একটি অস্থায়ী গ্রাম। কৌলকিম গ্রামের বাইরে গড়ে ওঠা সেই অস্থায়ী আশ্রয়ে নলখাগড়া দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট ঘর। এগুলোর ওপরে কাপড় বা ত্রিপল দেওয়া। বোকো হারামের তাণ্ডবে বাস্তুচ্যুত কয়েক শ পরিবার এসব ঘরে বাস করছে।

চার সন্তানের বাবা আলহাদজি ইয়ারো এমনই একটি ঘরে থাকেন। ঘরটি এতই ছোট যে রান্নার সামগ্রী এর ওপর রাখতে হয়। তিনি বলেন, কৈশোরেই তিনি লক্ষ্য করলেন, তাদের মাঠের ফসল আর আগের মতো হচ্ছে না। খরা আর বন্যায় ফসলহানিতে বুঝতে পারছিলেন, ভবিষ্যৎ হয়তো তেমন সুখের হবে না।

লেক চাদ অঞ্চলে বোকো হারামের সাবেক আরও ছয় সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদেরও গল্প প্রায় অভিন্ন। তাদের কেউ কেউ বোকো হারামে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেউ আবার বললেন, আর্থিক অনটন ও সরকারের কর্মকাণ্ডে হতাশা থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলেন।

বোকো হারামের সাবেক সদস্য মালিমিতি মাহামাত (৩৫) বললেন, তাঁরা বোকো হারামে যোগ দিয়েছিলেন, ‘কারণ, শস্যের উৎপাদন কমে আসছিল, পানির স্তর বদলে যাচ্ছিল।’

প্রাণক্ষয়ী হিসাব-নিকাশ

চিন্তক প্রতিষ্ঠান আডেলফির বিবেকানন্দ ও অন্যান্য গবেষকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও সহিংস সংঘাত মিলে মারাত্মক দুষ্টচক্র তৈরি করতে পারে।

যেসব এলাকায় সংঘাত নেই, সেসব অঞ্চলের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাইলে এলাকা ছাড়তে পারেন। কিন্তু লেক চাদের মতো যেসব অঞ্চলে কট্টরপন্থীদের তৎপরতা রয়েছে এবং তাদের দমনে সেনা অভিযান চলছে, সেসব অঞ্চলে মানুষকে হয় না খেয়ে থাকতে হবে, না হয় জঙ্গি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় থাকতে হবে।

লেখা: র‌্যাচেল চ্যাসন, সংক্ষেপিত অনুবাদ হাসান ইমাম

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.