১৩৩ দিন ধরে প্রেসক্লাবের সামনে কেন ফরিদের অবস্থান

0
135
প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন দাবি নিয়ে মায়ের সঙ্গে অবস্থান করছেন শেখ ফরিদ

১৩৩ দিন (প্রায় সাড়ে চার মাস) ধরে শেখ ফরিদ মৃধা নামের এক ব্যক্তি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বসে আছেন। প্রথমে পাটি বিছিয়ে স্ত্রী নাসরিন আক্তার এবং ৩ বছর বয়সী মেয়ে খাদিজাকে নিয়ে সকাল–সন্ধ্যা প্রেসক্লাবের সামনে বসে থাকতেন । প্রচণ্ড গরমে স্ত্রী ও সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়লে বাড়ি চলে যান। এখন ৬০ বছর বয়সী মা ফাতেমা বেগম ছেলের সঙ্গে আছেন।

শেখ ফরিদের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের রুস্তমপুর গ্রামে। প্রেসক্লাবের সামনে বড় একটি ব্যানারে তিনি দাবিগুলো লিখে রেখেছেন। ব্যানারে অবস্থানের কততম দিন হলো, সেটিও লিখে রাখেন।
ফরিদের ভাষ্য, জায়গাজমি নিয়ে বিরোধে প্রতিপক্ষ প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। জীবনের নিরাপত্তা নেই বলে তিনি বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

শেখ ফরিদ বলেন, ২০০৪ সালে তিনি সৌদি আরবে যান। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করে ভালো টাকা বেতন পেতেন। তাঁর আরেক ভাইও সৌদি আরবে ছিলেন। কিন্তু জমিজমা নিয়ে বিরোধ শুরু হলে তিন বছর আগে দুই ভাইকেই দেশে ফিরে আসতে হয়েছে।

মায়ের সঙ্গে প্রেসক্লাবের সামনে বসে আছেন শেখ ফরিদ
মায়ের সঙ্গে প্রেসক্লাবের সামনে বসে আছেন শেখ ফরিদ

শেখ ফরিদ ব্যানারে বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে যেসব হামলার শিকার হয়েছেন, তার ছবি দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় হামলার ভিডিও ফুটেজ প্রতিবেদককে পাঠিয়েছেন। ফরিদ বললেন, তিনটি কবরের জায়গাসহ ৪৮ দশমিক ৬২ শতাংশ জায়গা নিয়ে বিরোধ চলছে। প্রতিপক্ষ বিভিন্ন সময় এই জায়গা দখলের চেষ্টা করছে।

যে পরিবারের বিরুদ্ধে ফরিদের অভিযোগ, সেই পরিবারের ছেলে মো. মোজাম্মেল হোসেন (বাবুল) বলছেন, ফরিদকে তিনি বা তাঁর পক্ষে কেউ কোনো হুমকি দেননি। তবে বিরোধ চলছে বলে জানান তিনি। তাঁর ভাষ্য, দুই পক্ষই দুই পক্ষকে মারধর করেছে, মারধরের মামলায় তাঁকে কারাগারেও যেতে হয়েছিল। এখন তিনি জামিনে আছেন।

মোজাম্মেল হোসেন দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। এখন পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন।

ব্যানারে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন শেখ ফরিদ
ব্যানারে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন শেখ ফরিদ

কেন এই বিরোধ?

ফরিদ ও মোজাম্মেল হোসেনের বাড়ি কাছাকাছি। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও ফরিদ মোজাম্মেল হোসেনকে চাচা ডাকেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দফা দাবিতে ফরিদ প্রেসক্লাবের সামনে বসা শুরু করেন। ব্যানারে লেখা তাঁর দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তার দাবি। জমি নিয়ে বিরোধ চলছে যাদের সঙ্গে, সেই পরিবারের ছেলে মোশাররফ হোসেনের (বাহার) দাপট বন্ধ করার দাবি।

মোশাররফ হোসেন রাজধানীর মুগদা থানার সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনিও ঢাকায় থাকেন। তিনি গতকাল বলেন, ‘ফরিদ আমাদের যেভাবে অপমান করছে, তার বিচার আল্লাহ করবেন। সম্পত্তি এখনো বাবার নামে আছে। ভাইয়ের সঙ্গে ফরিদদের মারামারির যে ঘটনা ঘটেছে, তা ঘটা ঠিক হয়নি। এ ঘটনায় আমার ভাই চার দিন জেলেও ছিলেন। আর আমি কোনো প্রভাব খাটাচ্ছি কি না বা হুমকি দিচ্ছি কি না, তা স্থানীয় প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে।’

ফরিদের লাগানো ব্যানারে আগে ফরিদগঞ্জের সহকারী কমিশনারের (এসি ল্যান্ড) দেওয়া ভুল তদন্ত প্রতিবেদন বাতিল এবং চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক, ইউএনও, এসি ল্যান্ডের পক্ষপাতমূলক আচরণ বন্ধের দাবি ছিল। পরে ফরিদ সেগুলো  প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

ফরিদের ভাষ্য, তিন বছর ধরে মোজাম্মেল হোসেনের পরিবারের সঙ্গে বিরোধ চলছে শেখ ফরিদের পরিবারের। এ পর্যন্ত দুই পক্ষের পাঁচটি মামলার মধ্যে একটি মামলা খারিজ হয়েছে। চলমান চারটি মামলার মধ্যে তিনটি মামলার বাদী ফরিদ ও তাঁর ভাই ফয়েজ মৃধা। একটি মামলা করেছেন মোজাম্মেল হোসেন।

নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে বাড়ি ফিরবেন বলে জানালেন মা-ছেলে
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে বাড়ি ফিরবেন বলে জানালেন মা-ছেলে

গত রোববার দুপুরে প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে কথা হয় ফরিদ ও তাঁর মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। ফাতেমা বেগম বললেন, জীবনে প্রথমবার ঈদুল আজহায় কোরবানি দিতে পারলেন না। না খেয়ে প্রেসক্লাবের সামনে ছেলের সঙ্গে ঈদ কাটাতে হলো। তিনি ছেলেকে নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরতে চান। রোদ, বৃষ্টি এবং গরমে তিনি এখানে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

ফরিদ বলেন, প্রথম দিকে প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ ভেতরে ঢুকতে দিলেও এখন আর ঢুকতে দিচ্ছে না। যখন ভেতরে ঢুকতে দিত তখন প্রেসক্লাবের ভেতরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনকারীদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে কখনো কখনো খাবারের প্যাকেটের ব্যবস্থা করতে পারতেন। আর প্রেসক্লাবের কাছেই শিক্ষা ভবনের পাশে এলাকার পরিচিত একজন বাসায় তাঁদের থাকতে দিচ্ছেন। প্রস্রাব, পায়খানা করার জন্য ওই বাসায় যেতে হয়। ওই পরিবার মাঝে মাঝে খাবার দেয়। প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ও কেউ কেউ কিছু টাকা সাহায্য করেন। এভাবেই দিন পার হচ্ছে।

শেখ ফরিদ আরও বললেন, প্রতিপক্ষরা দখলসূত্রে জমির মালিক হতে যে মামলাটি দায়ের করেছিলেন, তা গত ১৩ জুন আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। আদালত উভয় পক্ষকে দেওয়ানি আদালতে বৈধ কাগজপত্র নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

শেখ ফরিদ বললেন, ‘আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা দেওয়ানি আদালতে বৈধ ৫টি দলিল জমা দিয়ে মামলা দায়ের করেছি। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই দুটি দাবি প্রত্যাহার করে নিয়েছি। কিন্তু প্রতিপক্ষের হুমকির জন্য বাড়ি ফিরতে পারছি না। মোজাম্মেল হোসেন মামলার রায়ের দিনও আদালত প্রাঙ্গণেই বলেছেন, বেঁচে থাকলে তো জমি খাবি।’

ফরিদ বললেন, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে বাড়ি ফিরবেন

ফরিদ এবারই প্রথম অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন, তা–ই নয়। এর আগেও ফরিদগঞ্জ এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন। চলতি বছরের বিভিন্ন সময় ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

ফরিদ বললেন, গত বছরের ২০ ও ২১ ডিসেম্বর প্রতিপক্ষের হামলার পর ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে একটানা ৯৬ ঘণ্টা তিনি অনশন করেছেন। এরপর ফরিদগঞ্জ থানা-পুলিশ মামলা নিয়েছে। গত বছরের ১৩ মে প্রতিপক্ষের হামলার পরও মামলা করেছেন ফরিদ।

শেখ ফরিদ আরও অভিযোগ করেন, গত বছরের ১৩ মে মোজাম্মেল হোসেন ও তাঁর অনুসারীরা রুস্তমপুর বাজারে প্রকাশ্যে তাঁদের দুই ভাইকে বেঁধে রড দিয়ে মারধর করেন। পুলিশ এসে ফরিদ শেখের হাত–পা খুলে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এ মামলাতেই পুলিশ মোজাম্মেল হোসেনসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

শেখ ফরিদের বাবা জয়নাল আবেদিন মৃধা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। ফরিদ অভিযোগ করে বলেন, মোজাম্মেল হোসেন শুধু নিজে নন, এলাকার আরেকজনকে দিয়েও মামলা করিয়েছেন।

তবে ফরিদের এসব অভিযোগ স্বীকার করেননি মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘ফরিদের বাবা আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন। ফরিদ আমাকে চাচা ডাকে। দাদা, দাদি এবং আমার বাবার কবর যে জায়গায়, তা নিয়ে জটিলতা চলছে। পূর্বপুরুষেরা ভুল করতেও পারেন। আমি বা আমার পাঁচ ভাই ফরিদ ও তাঁর ভাইকে বারবার বলেছি, তোমরা আমাদের কাছে জায়গা পেলে মাপজোখ করে নাও। ফরিদের পাশের বাড়ির আরেকজনের সঙ্গে ফরিদদের দ্বন্দ্ব চলছে, ফরিদ বলছে, ওই লোককে নাকি আমি মামলা করতে সহায়তা করেছি। এখন বলছে, ফরিদকে হুমকি দিচ্ছি। এসব অভিযোগ মিথ্যে।’

ফরিদগঞ্জ থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান টেলিফোনে বলেন, ‘শেখ ফরিদ ও মোজাম্মেল হোসেনদের পরিবারের মধ্যে জায়গাজমি নিয়ে বিরোধ চলছে। দুই পক্ষই মামলা করেছে। এসব মামলার রায় যা হবে, তা দুই পক্ষকেই মেনে নিতে হবে। আমরা এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে আছি।’

ফরিদ এলাকায় ফিরলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে, তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের বলে জানান ওসি আব্দুল মান্নান। কিন্তু সে জন্য তাঁকে এলাকায় ফিরতে হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বসে কথা বললে তো আমাদের করার কিছু নেই।’

তবে ফরিদের ভাষ্য, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলেই তিনি বাড়ি ফিরবেন। ফরিদের ভাই বাড়িতে একা থাকেন। দুই ভাইয়ের স্ত্রী বাবার বাড়িতে রয়েছে নিরাপত্তার জন্য।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.