বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে ভারত কতটা ভূমিকা রাখছে?

0
224
হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আগে পরস্পরের সমৃদ্ধি কামনা করছেন জো বাইডেন ও নরেন্দ্র মোদি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত মাসে যখন হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন অনেক পর্যবেক্ষকই এই বৈঠককে চীনের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন-দিল্লির দ্বিপক্ষীয় জোট গঠনের একটি প্রয়াস হিসেবে দেখছিলেন। তবে এমন ধারণা করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর যেমনটি স্পষ্ট করেছেন: যদিও আজকের এই বহুমুখী বিশ্বে নানা বিষয়ে দ্বিমত ও দ্বন্দ্ব থাকার পরও দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারি ধরে রাখা সম্ভব, তথাপি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ ধরনের কোনো আনুষ্ঠানিক জোট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

মনে রাখা দরকার, অন্য দেশের সঙ্গে জোট গঠনের ক্ষেত্রে ভারতের মধ্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক অবিশ্বাস কাজ করার একটি লম্বা ইতিহাস আছে। চীনের সঙ্গে ভারতের অবিশ্বাসের এই সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, বিশেষ করে ১৯৬২ সালে হিমালয় সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের লড়াই হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা রয়ে গেছে।

জিমি কার্টারের প্রশাসনে কাজ করার সময় আমাকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা যাতে সামাল দেওয়ার মতো অবস্থার বাইরে চলে না যায়, সে জন্য পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার ধারণার প্রতি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যেই আমাকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। ওই সময় আমাকে স্বাগত জানানো ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছিলেন, আমি যেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের তুলনা না করি; বরং আমি যেন পূর্ব এশিয়ার দেশ চীনের সঙ্গে তাদের তুলনা করি।

২০০১ সালের নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাবেক গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকেরা ফি বছর ‘ট্র্যাক টু’ নামে পরিচিতি পাওয়া বৈঠক করে আসছেন (এসব বৈঠকে আমেরিকার প্রতিনিধিদলে হেনরি কিসিঞ্জার ও রিচার্ড হলব্রুকের মতো কূটনীতিকেরাও ছিলেন)। এসব বৈঠকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আল–কায়েদা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে ভারতীয় কূটনীতিকেরা তাঁদের আমেরিকান প্রতিপক্ষের কাছে তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেন এবং এসব বিষয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা বলে থাকেন।

একই সঙ্গে তাঁরা মার্কিন কর্মকর্তাদের ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘হাইফেন বন্দী’ করে উপস্থাপন করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতেও অনুরোধ করে থাকেন। এসব বৈঠকে ভারতীয়রা অনেকবার চীনের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অবশ্য একই সঙ্গে তাঁরা চীনের সঙ্গে দৃশ্যত সুসম্পর্ক রাখতে এবং চীনা বাজারে ভারতের পণ্যের প্রবেশাধিকার জারি রাখতেও চেয়েছেন।

মূল কৌশলগত বাণিজ্যের নির্বাচিত কিছু খাতে চীনের সঙ্গে ভারতের ছাড়াছাড়ি হলেও ভারত এখনো চীনা বাজারে নিজের প্রবেশাধিকার ছেড়ে দিতে চায় না। ভারত একই সঙ্গে কোয়াডে থাকছে, আবার একই সঙ্গে দেশটি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা এবং ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংগঠন) বৈঠকেও থাকছে। যদিও ভারত এখন না জোট নিরপেক্ষতার কথা বলে, না কড়া বিধিনিষেধে ঘেরা কোনো জোটের বিষয়ে আগ্রহী।

চীন ভারতের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে বিগত দিনে চীনের অর্থনীতি ভারতের তুলনায় অনেক বেশি দ্রুততায় বেড়েছে। বাজারের বিনিময় হার ব্যবহার করে চীন এই শতাব্দীর শুরুতেই বিশ্ব জিডিপির ৩.৬ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। ভারতকে সেই স্তরে পৌঁছাতে ২০২০ সাল পর্যন্ত লেগে গেছে।

একজন ভারতীয় কৌশলবিদ বলেছিলেন, ‘আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো, আমরা কখনোই আপনাদের (মার্কিনিদের) ততটা অপছন্দ করব না, যতটা অপছন্দ আমরা চীনকে করে থাকি।’ ২০২০ সালে হিমালয় সীমান্ত এলাকায় চীনা সামরিক বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার অনেক আগেই তিনি এই কথা বলেছিলেন।

২০২০ সালের পর থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অবস্থান নেওয়া বেশ জোরালো হয়েছে। এক দশক আগেও যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার কূটনীতিকদের চতুর্পাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপ বা কোয়াডের বৈঠকগুলো তেমনটি গুরুত্ব পেত না। এখন এই বৈঠকগুলো অনেক জোরেশোরে উচ্চারিত হয় এবং বৈঠকগুলো সরকারপ্রধান পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া ভারত এখন অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি ও বড় পরিসরের যৌথ সামরিক মহড়া দিয়ে থাকে।

কিন্তু এই আয়োজন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আলাদা জোট গঠনের ধারণা থেকে অনেক দূরে। কারণ, ভারত এখনো তার মোট অস্ত্রের অর্ধেকের বেশি আমদানি করে রাশিয়া থেকে; যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞাধীন রুশ তেলের অন্যতম বড় ক্রেতাদের মধ্যে চীনের পাশাপাশি ভারতও আছে এবং প্রায়ই ভারত জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে থাকে।

১৯৭৯ সালে সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালানোর পর যেভাবে ভারত নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছিল, ঠিক একইভাবে ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন অভিযান চালানোর পর দিল্লি মস্কোর বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রসাদ উপভোগ করা ভারত আক্রান্ত গণতান্ত্রিক দেশ ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। অস্ত্র ও তেলের প্রাপ্যতা এবং রাশিয়াকে আরও চীনের অস্ত্রের দিকে ঠেলে দেওয়ার দায় এড়ানোই ভারতের কাছে শীর্ষ অগ্রাধিকারের বিষয়।

বাইডেন খুব সমাদর করে মোদিকে গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত করলেও অনুদার হিন্দু জাতীয়তাবাদ ইস্যুতে মোদির কড়া সমালোচনা করার লোকের অভাব পশ্চিমে, এমনকি ভারতেও হয়নি। এই দুই বৃহত্তম গণতন্ত্রের ‘অভিন্ন মূল্যবোধ’ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলো শুনতে খুব ভালো মনে হতে পারে, কিন্তু এসব বিবৃতির পক্ষে একটি দ্বিপক্ষীয় জোট গড়া সম্ভব নয়। আদতে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের চাবিকাঠি হলো চীনের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য ও সেই ভারসাম্যে ভারতের বিদ্যমান ভূমিকা।

সেই দিক থেকে ভারতের গুরুত্ব বাড়ছে। এ বছরের শুরুতে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারত চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। চীনের জনসংখ্যা ১৪০ কোটিতে পৌঁছে এখন তা কমতির দিকে যাচ্ছে এবং দেশটির শ্রমশক্তি সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ভারতের অর্থনীতি চলতি বছর চীনের চেয়ে দ্রুততায় বেড়ে ৬ শতাংশ হারে সম্প্রসারিত হওয়ার পথে রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। ভারতের অর্থনীতি যদি এই ধারায় প্রসারিত হতে থাকে, তাহলে মধ্য শতকের মধ্যেই ভারতের অর্থনীতি ইউরোজোন অর্থনীতির সমান হয়ে যাবে। বিপুল জনসংখ্যা, পারমাণবিক অস্ত্র, একটি বিশাল সেনাবাহিনী, ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তি, শক্তিশালী উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, উদ্যোক্তাভিত্তিক সংস্কৃতি এবং প্রভাবশালী প্রবাসীদের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা ভারত যে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হয়ে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত বাংলাদেশের কাছে কী চায়

মূল কৌশলগত বাণিজ্যের নির্বাচিত কিছু খাতে চীনের সঙ্গে ভারতের ছাড়াছাড়ি হলেও ভারত এখনো চীনা বাজারে নিজের প্রবেশাধিকার ছেড়ে দিতে চায় না। ভারত একই সঙ্গে কোয়াডে থাকছে, আবার একই সঙ্গে দেশটি সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা এবং ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সংগঠন) বৈঠকেও থাকছে। যদিও ভারত এখন না জোট নিরপেক্ষতার কথা বলে, না কড়া বিধিনিষেধে ঘেরা কোনো জোটের বিষয়ে আগ্রহী।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার ভারসাম্যের রাজনীতির মূল সূত্র মেনে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ‘বিয়ের মতো’ অঙ্গীকারের সম্পর্কে জড়াবে না, বরং তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি ‘পার্টনারশিপের’ সম্পর্কে থাকবে। আর সেই সম্পর্ক শুধু ততক্ষণই টিকবে, যতক্ষণ উভয়ের মধ্যেই চীন বিষয়ে উদ্বেগ কাজ করবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জোসেফ এস নাই জুনিয়র যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী প্রতিরক্ষাসচিব ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.