সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত এক সপ্তাহের টানা বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে জেলার কয়েকটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা এই মৌসুমে জেলায় সর্বোচ্চ বৃষ্টির রেকর্ড।
টানা বর্ষণে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাটে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের যাতায়াতে ঘটছে বিঘ্ন আর সীমাহীন ভোগান্তি। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়কের শক্তিয়ারখলা এলাকায় সড়কের বেশ কিছু অংশ প্লাবিত হওয়ায় যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেখানে মানুষেরা নৌকায় পারাপার হচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা বলছেন, ভারী বৃষ্টি আর উজানের ঢলের কারণে জেলায় পানি বেড়েছে। সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করলেও বৃষ্টি থামলে পানি কমবে। বড় বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই বলে আশ্বাস দিচ্ছেন তাঁরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টা সুনামগঞ্জসহ সিলেট অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে বন্যার বিষয়টি বলতে পারবে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা হয়েছে। জেলার কোথাও এখনো বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। পানি কিছুটা বেড়েছে। সীমান্ত এলাকায় পাহাড়ি ঢলে কিছু রাস্তাঘাটে পানি উঠেছে। তবে মানুষের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করার কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৪ জুন সুনামগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি ছিল ১৯৪ মিলিমিটার। এরপর গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে আজ রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৩৩২ মিলিমিটার। একই সঙ্গে সুনামগঞ্জের উজানে ভারতের মেঘালয়ে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়ি ঢল নামছে। এ কারণে সুনামগঞ্জে পানি বাড়ছে।
আজ সকাল ৯টায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার নিচে ছিল। দুপুর ১২টায় পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে। তখন নদীর পানির উচ্চতা ছিল ৭ দশমিক ৮৬ মিটারে। এখানে সুরমা নদীর পানির বিপৎসীমা ৭ দশমিক ৮০ মিটার। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের ছাতকে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্য নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে শুধু সুরমা নদী নয়, সুনামগঞ্জের যাদুকাটা, বৌলাই, রক্তি, কুশিয়ারা, চলতি, পাটলাই, নলজুর, খাসিয়ামারা, কালনীসহ সব নদ-নদীর পানিই বাড়ছে। এতে জেলার সদর, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার সদর উপজেলার নেয়ামতপুর থেকে তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুরমুখী সড়কের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের হরিপুর এলাকায় একটি সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়েছে। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ জানান, এলাকার মানুষজন ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। সেতুর সংযোগ সড়ক ধসে পড়ায় যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এ ছাড়া তাঁর এলাকার ১০ থেকে ১২টি ঘরে পানি প্রবেশ করেছে।
একই উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এরশাদ মিয়া বলেন, উপজেলার শক্তিয়ারখলা এলাকায় বিশ্বম্ভরপুর-তাহিরপুর সড়ক প্লাবিত হওয়ায় ওই স্থানে লোকজন নৌকা দিয়ে পারাপার হচ্ছেন।
শহরে জলাবদ্ধতা
ভারী বর্ষণে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাজীর পয়েন্ট, ষোলঘর, জামতলা, তেঘরিয়া, উত্তর আরপিননগর, হাসননগরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কাজীর পয়েন্ট এলাকায় আজ সকালে হাঁটুসমান পানি ছিল।
উত্তর আরপিননগর এলাকার বাসিন্দা আল হাবিব বলেন, দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছে। পানি বাড়ছে। এভাবে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকলে গতবারের মতো বন্যা দেখা দেবে কি না, মানুষের মধ্যে এ রকম আতঙ্ক হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেছেন, ‘আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ভারীর বৃষ্টির কারণেই শহরের কোথাও কোথাও সামান্য পানি জমেছে। এগুলো দ্রুতই নেমে যাবে। আমরা সব এলাকাতে খোঁজ রাখছি।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বলেন, মূলত বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণেই পানি বাড়ছে। বৃষ্টি কমলে পানিও কমবে। বড় বন্যার কোনো পূর্বাভাস নেই।
সুনামগঞ্জে গত বছর জুন মাসে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। ভারী বর্ষণের সঙ্গে উজানের ঢল নেমেছিল কয়েক দিন। শহরে ঢলের পানি ঢুকে গত বছরের ১৬ জুন সকালে। সন্ধ্যা নামার আগেই পুরো শহর প্লাবিত হয়ে যায়। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জ। বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সেবা। ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত মাথায় নিয়ে হাজারো মানুষ ছোটেন আশ্রয়ের খোঁজে। উঁচু ভবন, আত্মীয়স্বজনের বাড়িঘর, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেন মানুষ। সুনামগঞ্জ চার দিন সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সরকারি হিসাবে জেলার কমবেশি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। মারা যান ১৫ জন। ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় ৫০ হাজার।