র্যাব পরিচয় দিয়ে রাজধানীর গুলশান ও বনানী এলাকা থেকে দুই ব্যবসায়ীকে তুলে নেওয়া হয়। তাঁদের একজনের কাছ থেকে আদায় করা হয় ‘মুক্তিপণের’ টাকা। অভিযোগ পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী ওই দুই ব্যবসায়ীর পরিবার গুলশান ও বনানী থানায় আলাদা দুটি মামলা করেছে।
গ্রেপ্তার চারজন হলেন পুলিশের কনস্টেবল জাহিদ মিয়া (৩৫), শেখ ফরিদ (৩২), মুরাদ আলী খান (৩৫) ও হুমায়ূন কবির (৩৪)। তাঁদের মধ্যে জাহিদ মিয়া র্যাব-৯-এ সিলেটে কর্মরত ছিলেন। শেখ ফরিদ ছিলেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান কার্যালয় মালিবাগে। মুরাদ আলী ছিলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন)। আর হুমায়ূন কবিরও র্যাবে কর্মরত ছিলেন।
গ্রেপ্তারের পর তাঁদের সবাইকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে হুমায়ূন কবির ও মুরাদ আলী বর্তমানে জামিনে আছেন। অন্য দুজন এখনো কারাবন্দী।
গুলশান থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আমিনুল ইসলাম বলেন, হুমায়ূন কবির, মুরাদ আলীসহ কয়েকজন গত ১২ মে রাতে র্যাব পরিচয় দিয়ে আসাদুল নামের একজন ব্যবসায়ীকে গুলশানের তাহের টাওয়ারের সামনে থেকে মাইক্রোবাসে তোলেন। আসাদুলের ভাই বিষয়টি টহল পুলিশকে জানান। পরে গুলশান ৬৩ নম্বর সোসাইটি মসজিদের পাশের তল্লাশিচৌকি থেকে আসাদুলকে উদ্ধার এবং মুরাদ আলীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অপর দিকে বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কে এম মাহমুদুল হাসান বলেন, ১৮ মে র্যাব সদস্য পরিচয়ে বনানীর টিঅ্যান্ডটি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে থেকে ব্যবসায়ী জাকারিয়া খানকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় তুলে ৭০ হাজার টাকা আদায় করেন কনস্টেবল জাহিদ মিয়া ও শেখ ফরিদ। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ৩১ মে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
দোকানের সিগারেটসহ তুলে নেওয়া হয় আসাদুলকে
পুলিশ সূত্র ও মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, গুলশান-২-এ তাহের টাওয়ারের সামনে টংদোকানে সিগারেটের ব্যবসা করেন আসাদুল ও তাঁর ছোট ভাই আসলাম। ১২ মে রাত পৌনে ১১টার দিকে আসাদুল দোকানে বসে ছিলেন। তখন সেখানে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস এসে থামে। মাইক্রোবাসে থাকা মুরাদ আলী, হুমায়ূন কবিরসহ অন্যরা নিজেদের র্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেন।
এ সময় আসাদুল তাঁদের কাছে র্যাবের পরিচয়পত্র দেখতে চান। তখন একজন র্যাবের পরিচয়পত্র দেখান। একপর্যায়ে আসাদুলের হাতে হাতকড়া পরানো হয়। পরে দোকানের সিগারেটসহ আসাদুলকে মাইক্রোবাসে তুলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তাঁরা। ঘটনা টের পেয়ে আসাদুলের ছোট ভাই আসলাম সেখানে টহলরত গুলশান থানা-পুলিশকে বিষয়টি জানান।
গুলশান থানার পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, র্যাব পরিচয়ে আসাদুলকে তুলে নেওয়ার খবর জানার পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর গুলশানের সব কটি তল্লাশিচৌকিতে জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে গুলশান সোসাইটি মসজিদের সামনের তল্লাশিচৌকিতে তাঁরা ধরা পড়েন। সেখান থেকে থানায় নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পুলিশের কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ব্যবসায়ীকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত মুরাদ আলী এপিবিএনে কর্মরত। এর আগে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক পদে ছিলেন। তবে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাঁর পদাবনতি হয়।
এ বিষয়ে মামলার বাদী আসলাম বলেন, ‘র্যাব পরিচয়ে সেদিন রাতে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন কনস্টেবল মুরাদ আলীসহ অন্যরা। সেদিন আসামিদের ব্যবহার করা গাড়ির নম্বর গুলশান থানা-পুলিশকে জানানোর পর আসামিরা ধরা পড়েন।’
অবশ্য কনস্টেবল মুরাদ আলী খানের আইনজীবী এমদাদুল্লাহ মিয়া বলেন, তাঁর মক্কেল ফেঁসে গেছেন। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত নন। ঢাকার আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ মামলায় হুমায়ূন কবির ও মুরাদ আলী ১৪ জুন জামিন পেয়েছেন।
‘তুলে নেওয়ার পর মামলায় ফাঁসানোর ভয়’
বনানী থানায় করা মামলার কাগজপত্র বলছে, জাকারিয়া খান পেশায় পোশাক ব্যবসায়ী। ১৮ মে দিবাগত রাত ১২টার দিকে তিনি বনানীর টিঅ্যান্ডটি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় সেখানে একটি অটোরিকশা থামে। পরে কনস্টেবল জাহিদ মিয়া ও শেখ ফরিদ নিজেদের র্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে জাকারিয়াকে ওই অটোরিকশায় তুলে নিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে বনানী থানার এসআই কে এম মাহমুদুল হাসান বলেন, ব্যবসায়ী জাকারিয়াকে তুলে নেওয়ার পর তাঁর কাছে থাকা ৪০ হাজার টাকা কেড়ে নেন জাহিদ ও ফরিদ। পরে জাকারিয়ার বড় ভাইয়ের মুঠোফোন থেকে আরও ৩০ হাজার টাকা আসামিদের মুঠোফোনে পাঠানো হয়।
ভুক্তভোগী জাকারিয়া বলেন, ‘র্যাব পরিচয়ে আমাকে তুলে নেওয়ার পর মারধর করা হয়। একপর্যায়ে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় নিয়ে যান। আমি তাঁদের বারবার বলছিলাম, আমাকে আপনাদের র্যাবের কার্যালয়ে নিয়ে চলেন। আমাকে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়। পরে তাঁরা ৭০ হাজার টাকা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেন।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে নিরীহ ব্যবসায়ীদের তুলে নিয়ে টাকা আদায় গুরুতর অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে নিয়মের শিথিলতা থাকার কারণে বাহিনীর সদস্যরা দুষ্কর্মে জড়িয়ে পড়ার সাহস পাচ্ছেন। জবাবদিহি না থাকার কারণে এমন ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।