চামড়াশিল্প নগরে এবারও ব্যাপক দূষণের শঙ্কা

0
147
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে চামড়াশিল্প

সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা অবশ্য বলেন, কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এবারের ঈদে এক কোটি পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন সাভারের চামড়াশিল্প নগরের ব্যবসায়ীরা। আর এই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে চামড়াশিল্প নগরের ১৪২টি ট্যানারি প্রয়োজনীয় লবণ, রাসায়নিক দ্রব্য ও অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়ে এখন প্রস্তুত রয়েছে।

তবে সাভার চামড়াশিল্প নগরের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় প্রতিবছরের মতো এবারও পরিবেশ ও নদীদূষণের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন কিছু ট্যানারিমালিক। তাঁদের যুক্তি, সিইটিপির দৈনিক তরল বর্জ্য পরিশোধনের ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার। কিন্তু কোরবানির সময় তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ঘনমিটার। অর্থাৎ সিইটিপির ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রতিদিন বর্জ্য ৫ থেকে ১০ হাজার ঘনমিটার বেশি হবে। তাই অতীতের মতো এবারও বাড়তি তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই চামড়াশিল্প নগরের পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়বে। এতে নদীসহ পরিবেশদূষণের জোরালো আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, সিইটিপি এখনো অসম্পূর্ণ। তাই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ট্যানারিমালিকেরা এখানে সাত–আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছেন না। এখন প্রায় ২০টি ট্যানারি এই সনদ পাওয়ার মতো অবস্থায় থেকেও এ ব্যাপারে আবেদন করতে পারছে না। এলডব্লিউজি সনদ পেলে আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে যে দরে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে, এর প্রায় তিন গুণ বেশিতে বিক্রির সুযোগ হবে।

অন্যদিকে সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তার দাবি, এবার ট্যানারি থেকে উৎপাদিত কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে সিইটিপির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির (ডিটিআইইডব্লিউটিপিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সিইটিপির যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে, তা নিয়েই আমরা প্রস্তুত আছি। সিইটিপিতে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মেরামত ও পরিবর্তন করা হয়েছে।’

সিইটিপি এখনো অসম্পূর্ণ। তাই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় ট্যানারিমালিকেরা এখানে সাত-আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাচ্ছেন না।

— সাখাওয়াত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক, বিটিএ।শামসুজ্জামান, সাভার

মোস্তাক আহমেদ বলেন, কঠিন বর্জ্য ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলাটা আসলে স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে প্রতিষ্ঠানটি পুরো সিইটিপি ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করবে।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা এলাকায় বিসিক চামড়াশিল্প নগরের বিভিন্ন ট্যানারির মেঝে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মেশিনের যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারখানার ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আনা লবণসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পণ্যের ড্রাম।

মেরামত করা হচ্ছে ট্যানারি থেকে তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের নালা। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পিকআপে করে বিভিন্ন ট্যানারির উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য এনে ফেলা হচ্ছে সিইটিপির পাশে নদীর পাড়ঘেঁষা উন্মুক্ত ডাম্পিং ইয়ার্ড বা আস্তাকুঁড়ে। এখান থেকে পচা-উৎকট গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট গর্ত থাকায় সেগুলোয় ইট–সুরকি ফেলে মেরামত করা হচ্ছে।

ঈদ সামনে রেখে ডাম্পিং ইয়ার্ডের ভেতরে বিশাল আকৃতির গর্ত করা হয়েছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য। ডাম্পিং ইয়ার্ড বা আস্তাকুঁড়সংলগ্ন সড়কের উভয় পাশে রাখা হয়েছে কঠিন বর্জ্য। এসব বর্জ্য থেকে নির্গত লালচে রঙের তরল বর্জ্য সড়কের বেশ কিছু অংশে ছড়িয়ে রয়েছে।

সিইটিপির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুপারভাইজার মো. হিমেল বলেন, শিল্পনগরের ভেতর সলিড ওয়েস্টের জন্য তিনটি ডাম্পিং ইয়ার্ড আছে। এগুলোর মধ্যে একটি বর্জ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে। আরেকটির অর্ধেক খালি রয়েছে। এ ছাড়া নদীর পাড়ে আস্তাকুঁড়ের একটি অংশ খনন করে অন্য ডাম্পিং ইয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে।

ট্যানারিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারিগুলো থাকাকালে প্রতিদিন গড়ে ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলা হতো। এ ছাড়া চামড়ার উচ্ছিষ্ট বেড়িবাঁধসহ বিভিন্ন রাস্তার পাশে, খালে ও জলাধারে ফেলে রাখা হতো। ২০০৩ সালে শিল্পমন্ত্রণালয় চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প হাতে নেয়। ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে ১৫৪টি ট্যানারিকে প্লট দেওয়া হয়। ২০১২ সালে একটি চীনা কোম্পানি ৫৪৭ কোটি টাকায় সিইটিপি নির্মাণের কাজ পায়।

বিভিন্ন ট্যানারির উৎপাদিত তরল বর্জ্য সিইটিপিতে পরিশোধন করে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে ফেলার কথা। কিন্তু ট্যানারিগুলোয় সিইটিপির পরিশোধনের সক্ষমতার চেয়ে বেশি তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এসব বিষাক্ত তরল বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই নদীতে ফেলা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ নিয়ে ডিটিআইইডব্লিউটিপিসির এমডি মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘সামগ্রিক বিবেচনায় সিইটিপি করা হলেও আমি মনে করি যে প্রতিটি কারখানার নিজস্ব ইটিপি থাকা প্রয়োজন।’

বিসিক চামড়াশিল্প নগরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান রিজওয়ান বলেন, ‘চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সামগ্রিক বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় করণীয় বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ট্যানারিমালিকদের সঙ্গে বিসিকের একটি সভা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়াগুলো যেন সুন্দরভাবে ট্যানারিতে প্রবেশ করতে পারে, সে লক্ষ্যে কন্ট্রোলরুম স্থাপন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী রাখা হবে। আশা করছি, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবেই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সব কার্যক্রম সম্পন্ন হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.