২০০২ সালের কথা। মতিউর রহমানের বয়স তখন ১৫। মা-বাবার বুক শূন্য করে হারিয়ে যান তিনি। এর পর থেকে হন্যে হয়ে দেশের সম্ভাব্য সময় জায়গায় খোঁজা হয়েছে। মতিউরের দেখা পাওয়া যায়নি। ২১ বছর পর হারানো সেই ছেলেকে ফিরে পাচ্ছেন ঠাকুরগাঁওয়ের সহিদুল ইসলাম-মর্জিনা বেগম দম্পতি।
কাল মঙ্গলবার ভারত থেকে মতিউরের দেশে ফেরার কথা। তিনি ফিরবেন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে। তবে মতিউর কবে, কীভাবে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন, সেই জট এখনো খোলেনি।
হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় বাবা সহিদুল ইসলাম আর মা মর্জিনা বেগম। সহিদুল ইসলাম বলেন, কাল তাঁকে হিলি যেতে বলা হয়েছে। তাঁর ছেলে মতিউর দেশে ফিরবেন।
ঠাকুরগাঁও জেলার আখানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ দেবিডাঙ্গা গ্রামের সহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগম দম্পতির বড় ছেলে মো. মতিউর রহমান। তাঁর জন্ম ১৯৮৭ সালে।
২০০২ সালেই ছেলে হারানোর কথা ঠাকুরগাঁও থানায় জানিয়েছিলেন উল্লেখ করে সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে ছেলেকে খুঁজেছি। কোথাও পাইনি।’
কাল ২৭ জুন মতিউর রহমান দেশে ফিরছেন—এ তথ্য জানা গেছে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ভরত ভাটওয়ানির পাঠানো একটি ই-মেইল থেকে।
ওই ই-মেইল তিনি পাঠিয়েছেন সম্পাদক মতিউর রহমান, আইসিডিডিআরবির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরিসহ ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। ভরত ভাটওয়ানির চিঠিতে কোথায়, কীভাবে মতিউর রহমানকে উদ্ধার করা হয়েছিল, কীভাবে তাঁর চিকিৎসা হয়েছিল, সেই বর্ণনা আছে।
শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা রাস্তায় থাকেন, তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজ করে। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত তামিলনাড়ু, রাজস্থান, কেরালা, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গ, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা এবং প্রতিবেশী দেশ নেপালের মানসিকভাবে অসুস্থ ১০ হাজারের বেশি মানুষকে তারা সেবা দিয়েছে। সুস্থ করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।
শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের সমাজকর্মীরা ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার রাস্তা থেকে মো. মতিউর রহমানকে উদ্ধার করেন। তখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। সময়টা ছিল ২০১৯ সালের জুন মাস। তাঁর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকেরা তাঁকে চিকিৎসা দেন। মতিউরকে সম্ভাব্য সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। একসময় জানা যায়, তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে।
এরপর করোনা মহামারি শুরু হয়। অন্যান্য অনেক কাজের মতো মতিউরের বাড়ি খোঁজার বিষয়টিও স্থবির হয়ে পড়ে।
করোনা মহামারির ভয়াবহতা কমে আসার পর আহমেদাবাদের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্নেহালয় বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হয়। মতিউরকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের রাহা নবকুমার ও তাঁর স্ত্রী তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের নীতীশ শর্মা। নীতীশ শর্মা একজন বাঙালি। রাহা নবকুমার ও তন্দ্রা বড়ুয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে একসময় ঠাকুরগাঁওয়ে মতিউরের পরিবার খুঁজে পাওয়া যায়।
মতিউরের বাবা সহিদুল ইসলাম বলেন, মাস ছয়েক আগে একটি ফোন আসে। ফোনে ছেলে বেঁচে আছেন, ভারতে আছেন জানানো হয়। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়েছে। এরপর ছেলে ফেরত আসার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে।
পবিত্র ঈদুল আজহা আগামী বৃহস্পতিবার। এর দুই দিন আগে মতিউরকে ফিরে পাবেন তাঁর মা–বাবা, পরিবার ও স্বজনেরা। ঈদের ঠিক আগে এই পুনর্মিলন কতটা আনন্দের হবে, সে কথাও চিঠিতে লিখতে ভোলেননি শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ভরত ভাটওয়ানি।