ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চলে নিজের বাগানে কাজ করার সময় হো সাই বে (৬২) মাটির ঢিলার চেয়ে বেশি শক্ত একটা কিছুর অস্তিত্ব টের পান। সাবধানে তিনি যখন সেটির গায়ে হাত রাখেন, বুঝতে পারেন সেটা একটা অবিস্ফোরিত ছোট আকারের ক্ষেপণাস্ত্র।
যদিও হো সাই বে নিশ্চিত ছিলেন না যে ক্ষেপণাস্ত্রটি অক্ষত আছে কি না, তবুও তিনি সতর্কতার সঙ্গে সেটিকে তুলে নিয়ে তাঁর সবজির ওপর রাখেন।
গত বৃহস্পতিবার অবিস্ফোরিত ক্ষেপণাস্ত্রটি পান হো সাই বে। কুয়াং ত্রি প্রদেশে নিজের বাড়িতে তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান।
এর আগে অন্যান্য জিনিসও পেয়েছেন উল্লেখ করে হো সাই বে বলেন, ‘যুদ্ধের পর আমি নানা ধরনের যুদ্ধাস্ত্রসহ বোমা-বিস্ফোরক সংগ্রহের কাজ করতাম এবং তখন অনেক ধরনের বিস্ফোরক পেয়েছি। সেই ১৯৭৫ সালে যখন আমি ২০ বছরের যুবক, তখন আমি মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে বড় বড় বিস্ফোরক পেয়েছি। সেগুলো তখন বিক্রি করতাম।’
হো সাই বের বাড়ির পেছনেই রয়েছে একটি ভাঙাচোরা গির্জা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনামি সেনাসদস্যরা সেখানে লুকিয়ে থাকতেন। ওই স্থানটিকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালিয়েছিল মার্কিন সেনাবাহিনী। তখন ওই অঞ্চল সাইগন নামে পরিচিত ছিল।
নিজের বাগানের একটি স্থান দেখিয়ে হো সাই বে বলেন, ‘১৯৭৯ সালে এখানে আমি একজনের দেহাবশেষ পেয়েছিলাম।’ স্থানটিতে আরও ভিয়েতনামি সেনাদের দেহাবশেষ ছিল, সেগুলো কর্তৃপক্ষ নিয়ে যায়।
২০ বছর মেয়াদি ভিয়েতনাম যুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির বিভিন্ন স্থানে যুক্তরাষ্ট্র ১০ লাখের বেশি বার বোমা হামলা চালিয়েছে। এসব হামলায় ৫০ লাখ টনের মতো বোমা-বিস্ফোরক ফেলেছেন মার্কিন সেনারা। এর মধ্যে গুচ্ছ বোমাসহ (ক্লাস্টার বোম্বস) এক-তৃতীয়াংশ বিস্ফোরক অক্ষত অবস্থায় ছিল। সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি।
৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৯৭৩ সালের ২৯ মার্চ ভিয়েতনাম ছেড়েছেন মার্কিন সেনারা। এখনো প্রতিবছর হাজার হাজার অবিস্ফোরিত বিস্ফোরক পাওয়া যাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে মাটির মাত্র কয়েক ইঞ্চি নিচে।
‘যুদ্ধের বাস্তবতা’
কুয়াং ত্রি প্রদেশ একসময় নিরস্ত্রীকরণ এলাকা হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে বিভাজিত হয়েছিল। দেশটির মধ্যে এই প্রদেশেই সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরক ফেলা হয়েছিল। যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে অবিস্ফোরিত নানা ধরনের বিস্ফোরকে। এর মধ্যে সবশেষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে। একজন কৃষক তার জমিতে একটি বিস্ফোরক পেয়েছিলেন। সেটি হাতে তুলে নিতেই বিস্ফোরণ ঘটে।
হো সাই বে বলেন, ‘দুর্ঘটনায় অনেক মৃত্যু দেখার পর বিস্ফোরক সংগ্রহের কাজ আমি বাদ দিই।’ তবে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার পরও তিনি অসন্তুষ্ট নন। এর কারণ হিসেবে হো সাই বে বলেন, ‘আমিও অন্যদের মতো বিষয়টিকে অনুভব করি… এটা আসলে যুদ্ধেরই বাস্তবতা।’
১৯৯৯ সাল থেকে ভিয়েতনামে কাজ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দ্য মাইনস অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (এমএজি)। সংস্থাটির ৭৩৫ কর্মী ভিয়েতনামজুড়ে কাজ করেন। স্থানীয় হটলাইনে ফোন করার পর হো সাই বের বাগানে এসেছিলেন বোমা অপসারণের জন্য।
এমএজির কর্মীরা প্রতিদিন মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকের (ইউএক্সও) সন্ধান করেন, যাতে জমি-জায়গা ঝুঁকিমুক্ত হয় এবং তা কৃষিকাজ বা অন্য কোনো উন্নয়নকাজের জন্য ব্যবহার করা যায়। ২০২২ সালে সংস্থাটি ১৪ হাজার ৬১৫টি বোমা ধ্বংস করেছে এবং এর মাধ্যমে ১০ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা বা ভূমি বিস্ফোরণের ঝুঁকিমুক্ত হয়েছে।
পাশের জুয়ান ভিয়েন নামের একটি গ্রামে স্থানীয় শিশুরা খালে নেমেছিল। কাদায় মাখামাখি ওই খালে ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুরা ঝাপাঝাপি করার সময় অস্বাভাবিক ধরনের একটি বস্তু দেখতে পায়।
জুয়ান ভিয়েন গ্রামের প্রধান ত্রান দুই ভিন আল-জাজিরাকে বলেন, শিশুরা তার আগেই ফুটবল খেলেছে। এরপর তারা খালে নামে যদি কিছু মাছও পায়, সেই আশায়।
গ্রামপ্রধান ত্রান দুই ভিন বলেন, শিশুরা একটি বিস্ফোরক পায় এবং সেটি কুড়িয়ে নেয়। এরপর সেটিকে একে অপরের হাতে দেওয়ার খেলা শুরু করে। শিশুরা জানত না সেটি আসলে কী।
তৎক্ষণাৎ সরকারি হটলাইনে ফোন করেন উল্লেখ করে ত্রান দুই ভিন বলেন, এই হটলাইনে ফোন করলে এমএজির মতো সংস্থাগুলো বিষয়টি জানতে পারে এবং তারা ইউএক্সও অপসারণে পদক্ষেপ নেয়। একই সঙ্গে ভিয়েতনামি সেনাবাহিনীও বিষয়টি জানতে পারে এবং তার এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়। ওই হটলাইন নম্বর এখানকার সবার কাছে আছে বলেও জানান তিনি।
সরকারি সংস্থা কুইন ত্রি মাইন অ্যাকশন সেন্টার (কিউটিএমএসি) এই হটলাইন নম্বরটি পরিচালনা করেন। সংস্থাটির উপপরিচালক দিন নক ভু বলেন, ‘আমি মনে করি, এই কাজ যুদ্ধের ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করছে।’
১৯৯৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনামে ১৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল বোমাসহ অন্যান্য বিস্ফোরক (ইউএক্সও) অপসারণ এবং এর ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে জানাতে শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
চলতি বছরের এপ্রিলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ভিয়েতনাম সফর করেন। সে সময় তিনি বলেন, যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবিলায় ওয়াশিংটন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘যদিও আমাদের দৃষ্টি ভবিষ্যতে নিবদ্ধ… আমরা অবিস্ফোরিত বিস্ফোরক (ইউএক্সও) অপসারণে যৌথভাবে কাজ করে যাব। পরের মাসেই আমরা ব্যাপক বোমা হামলার শিকার কুয়াং ত্রি প্রদেশের জরিপ শেষ করব।’
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও ভিয়েতনামি সেনারা এরই মধ্যে ১৭৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে ইউএক্সও অপসারণ করেছে। ভিয়েতনামের সরকারি সংস্থা কুইন ত্রি মাইন অ্যাকশন সেন্টারের অনুমান, প্রদেশটি থেকে সব অবিস্ফোরিত বোমাসহ অন্যান্য বিস্ফোরক অপসারণে আরও ১৩ বছর লাগবে।
যে কাজে অন্যের জীবন রক্ষা পায়
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষে দেশটির এমন কোনো প্রদেশ ছিল না যেটি অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এমএজির ভিয়েতনামের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারাহ গোরিংয়ের হিসাবে, যুদ্ধের সময় ফেলা বিভিন্ন অবিস্ফোরিত বোমা-বিস্ফোরকের কারণে গত ৫০ বছরে ১০ হাজারের বেশি মানুষ হতাহত হয়েছেন।
সারাহ গোরিং জানান, তাঁরা অবিস্ফোরিত বোমা-বিস্ফোরক পাওয়ার পর ঘটনাস্থলেই তা ধ্বংস করেন অথবা সেটি নিরাপদে ধ্বংস করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যান।
১৯৯৯ সাল থেকে এমএজির সঙ্গে কাজ করছেন তা কুয়াং হুং। বর্তমানে তিনি সংস্থাটির টেকনিক্যাল ফিল্ড ম্যানেজার। এমএজিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি গ্রামীণ এলাকায় কৃষিকাজ করতেন, ওই সব এলাকায় প্রচুরসংখ্যক অবিস্ফোরিত বোমা-বিস্ফোরক ছিল।
তা কুয়াং হু আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমি যে এলাকায় বেড়ে উঠেছি, সেখানে প্রচুরসংখ্যক অবিস্ফোরিত বোমা-বিস্ফোরক ছিল। এরপরও আমি ঘরে বসে থাকিনি এবং পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি।’
তা কুয়াং হু তাঁর শৈশবে এসব অবিস্ফোরিত বোমা-বিস্ফোরক নিয়ে খেলাধুলা করেছেন। কারণ, তাঁরা জানতেনই না সেগুলো কী। এমনও হয়েছে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা ছোট আকারের বিস্ফোরক ছুড়ে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার খেলায় মাততেন। তবে বড়রা তাঁদের সেই ভয়ঙ্কর খেলা থামিয়ে দিতেন। অবশ্য সবার তেমন সৌভাগ্য হতো না।
তা কুয়াং হুয়ের এখনো স্পষ্ট মনে আছে গত শতকের ৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের একটি বিয়োগায়ত্মক ঘটনার কথা।
তা কুয়াং হু জানান, যুদ্ধের সময় তাঁরা এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে যুদ্ধ শেষে বাড়িঘরে ফিরে আসেন এবং পুনরায় কৃষিকাজ শুরু করেন।
এক দিন আত্মীয় এক দম্পতি মাঠে একসঙ্গে কাজ করছিলেন উল্লেখ করে তা কুয়াং হু বলেন, তাঁরা দুজনই বিস্ফোরণের শিকার হন। সম্ভবত সেটি ছিল ৪০ এমএম গ্রেনেড অথবা গুচ্ছ বোমা… দুজনই নিহত হন।
থাই ভ্যান নিন নামের আরেক ব্যক্তি এমএজির সঙ্গে কাজ করছেন ২০১৫ সাল থেকে। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৬, তখন তাঁর ১২ বছর বয়সী বড় ভাই একটি অবিস্ফোরিত বোমার বিস্ফোরণে প্রাণ হারান।
থাই ভ্যান নিন বলেন, ‘যখন প্রথম শুরু করি, বোমা-বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করতে মনে ভয় কাজ করত। আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি। তবে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর আমি উপলব্ধি করি, আমার কাজের মাধ্যমে অন্যের জীবন রক্ষা পায়।’