অভিমান ও আকুলতার গান ‘কথা কইয়ো না’

0
213
ইমন চৌধুরী, আলেয়া বেগম এবং এরফান মৃধা

‘কোনবা দেশে থাকে ভোমরা, কোন বাগানে বসে
কোনবা ফুলের মধু খাইতে উইড়া উইড়া আসে…।’

গানের কথাগুলোর সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই শ্রোতারা উড়ে উড়ে দুলে দুলে বেড়াচ্ছেন। গুনগুনিয়ে উঠছেন মনের অজান্তেই। এটা কোন গান?
নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় মৌসুমের ‘কথা কইয়ো না’। এ গানকে কোক স্টুডিও কর্তৃপক্ষ বলছে ‘জাদুকরি ফিউশন’। এটিতে রয়েছে শহুরে গান আর লোকসংগীতের সুরেলা সংমিশ্রণ।

মনের শান্তির ধারক আমাদের প্রিয়জন। মানসিক শান্তির জন্য আমরা বারবার প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যেতে চাই। ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইয়ো না…’—এমন কথাতেই প্রকাশ ঘটেছে প্রিয়জনের প্রতি আকুতি এবং অভিমানের। গানটিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আধুনিক গানের সঙ্গে মৈমনসিংহ গীতিকার ফিউশনের ব্যবহার করা হয়েছে। কোক স্টুডিও বাংলার নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে ১০ জুন প্রকাশিত গানটি এরই মধ্যে লাখ লাখ দর্শক–শ্রোতার মন কেড়ে নিয়েছে।
মনের আকুতি মেশানো প্রেমময় এ গান লিখেছেন নিভৃতচারী কবি হাশিম মাহমুদ। সুর ও সংগীত প্রযোজনায় ছিলেন শিল্পী ইমন চৌধুরী। গানটির মূল শিল্পী এরফান মৃধা, যিনি শিবলু নামে পরিচিত, তিনি হাশিম মাহমুদের সঙ্গে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন। আরও রয়েছেন অসাধারণ কণ্ঠস্বরের অধিকারী লোকসংগীতশিল্পী আলেয়া বেগম।

গানটির সুরকার ও সংগীত প্রযোজক ইমন চৌধুরী বলেন, ‘এর আগে হাশিম ভাইয়ের লেখা এবং শিবলুর গাওয়া “সাদা সাদা কালা কালা” গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম “কথা কইয়ো না” গানটিও তেমনিভাবে দর্শকশ্রোতাকে ছুঁয়ে যাবে। আমাদের আশাভঙ্গ হয়নি। দর্শক–শ্রোতার এমন সাড়ায় আমরা অভিভূত, কৃতজ্ঞ। কোক স্টুডিও বাংলার মাধ্যমে শিল্পীরা একটা প্ল্যাটফর্ম পেয়েছি, যেখানে সংগীতের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি। আর দর্শক-শ্রোতারাও আমাদের সঙ্গে একটি মন্ত্রমুগ্ধকর যাত্রায় শামিল হতে পারেন।’

কবি হাশিম মাহমুদ
কবি হাশিম মাহমুদ

গানের ভিডিওতে দেখা যায়, এরফান মৃধা শিবলু ও তাঁর বোহেমিয়ান শহুরে শিল্পী-বন্ধুদের দল একটি গ্রামে বেড়াতে যায়। সেখানে তারা আলেয়া বেগম ও তাঁর নারী বাউল দলের সঙ্গে মিলে শ্রুতিমধুর এ গান তৈরি করে। দুই মূল শিল্পীরই নিজেদের ‘দোহার’ ছিল। শিবলুর সঙ্গে ছিলেন আধুনিক বাদ্যযন্ত্র আর আধুনিক ব্যাক ভোকালের দল। অন্যদিকে, আলেয়া বেগমের নেতৃত্বে ছিল নারী বাউলদের অর্কেস্ট্রা। এই প্রথমবারের মতো কোক স্টুডিও বাংলা বা অন্য কোনো প্ল্যাটফর্মে বাউল অর্কেস্ট্রা দেখা গেছে। মূল শিল্পীরা ও তাঁদের দোহার চমৎকারভাবে শহুরে গান ও লোকসংগীতের সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন, আর মাঝে ইমন চৌধুরী পুরো পরিবেশনাকে এক সুতোয় গেঁথেছেন।

এরফান মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি হাশিম ভাইয়ের সঙ্গে বহু বছর ধরে কাজ করছি। তাঁর গানের কথা খুব সাধারণ কিন্তু হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। কোক স্টুডিও বাংলাতে তাঁর লেখা গান গাইতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত।’

আলেয়া বেগম বলেন, ‘আমি গানটিতে মৈমনসিংহ গীতিকাকে তুলে এনেছি। শহুরে সুরের সঙ্গে আমাদের লোকসংগীতের শিকড়কে মিশিয়ে জাদুকরি একটা গান তৈরি হয়েছে। গানটি প্রকাশ পাওয়ার পর সবাই এত ফোন করছে, ভালো লাগার কথা জানিয়েছে, এটা আমার পরম পাওয়া।’

গান গাওয়া বা শুটিংয়ের সময় কি কোনো ঘটনা আছে, যা পাঠককে জানাতে চান? আলেয়া বেগম বলেন, ‘গান গাওয়ার জন্য ইমন ভাই যখন প্রথম ডাকেন, আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। গলা ভাঙা ছিল। সেদিন কোনোভাবেই গাইতে চাইছিলাম না। ইমন চৌধুরী আমাকে সাহস দিলেন গাওয়ার। তারপর কী আন্তরিকতার সঙ্গে এই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করলাম!’

একই প্রশ্ন ছিল শিবলুর কাছেও। শিবলু বললেন, ‘আসলে পুরো যাত্রাই মজার। শিহরণের। একটা মজার ঘটনা হলো, গান গাওয়ার সময় আমি যে রোদচশমা ব্যবহার করি, সেটা শেষ মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দুদা বদলে দিলেন। বললেন, যদি কোক স্টুডিও লেখা থাকত, তাহলে এই চশমা ব্যবহার করা যেত। এটা আমার মজা লেগেছে।’
গান তৈরির পেছনের গল্প প্রসঙ্গে ভিডিও পরিচালক কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘গানের শুরুতে পাতার বাঁশি ব্যবহার করা হয়। এটা যাঁরা গ্রামে বড় হয়েছেন, তাঁদের অন্য রকম অনুভূতি দেবে। তাঁদের বড় হওয়ার সঙ্গে এই ধারা মিশে আছে। গানটির দৃশ্যায়নে দেখা যায়, চাঁদের আলোয় আলোকিত একটি গ্রামের বাড়ির উঠান। যুগ যুগ ধরে এমন চাঁদনি রাতে বাংলাদেশের গ্রামের উঠানে গানের আসরের আয়োজন হয়ে আসছে। পূর্ণিমারাতের সৌন্দর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক গানও সৃষ্টি হয়েছে। কোক স্টুডিও বাংলা এ ধরনের গানের আসরকেই তুলে ধরেছে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.