ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২২৯ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা

0
159
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে ১ হাজার ১৫০টি মামলার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করেছে আর্টিকেল-১৯। এতে দেখা গেছে, ১১৫টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে

সাড়ে তিন বছরে বিতর্কিত এই আইনে গ্রেপ্তার ৫৬ জন সাংবাদিক।

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত প্রায় সাড়ে তিন বছরে ১১৫টি মামলায় ২২৯ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে  ৫৬ জন সাংবাদিককে। মামলা দায়েরের পরপরই কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যের ভিত্তিতে এমন চিত্র তুলে ধরেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন আর্টিকেল-১৯। এই সংগঠনটি মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করে।

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগই এখন অপপ্রয়োগ। এই আইনে করা মামলার আসামিদের মধ্যে বড় অংশই সাংবাদিক। আর বেশির ভাগ মামলার বাদী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী বা সমর্থক।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে ১ হাজার ১৫০টি মামলার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করেছে আর্টিকেল-১৯। এতে দেখা গেছে, ১১৫টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২২৯ জন সাংবাদিককে।

৫ জুন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে জানান, সারা দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট ৭ হাজার ১টি মামলা (২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত) হয়েছে। তবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনে মোট কতটি মামলা হয়েছে, সে বিষয়ে আলাদাভাবে কোনো তথ্য উপস্থাপন করেননি তিনি।

বিতর্কিত এই আইনে করা ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজও (সিজিএস)। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ওই সব মামলা করা হয়। সিজিএসের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এসব মামলার মধ্যে ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

শুরু থেকেই সমালোচনা

ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও সরকার ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে। এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই আশঙ্কা ও উদ্বেগ জানিয়েছিল মতপ্রকাশ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দেশি–বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিক ইউনিয়নসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও এই আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়ে বারবার উদ্বেগের কথা বলে আসছে। এই আইনের আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরা হলেও সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে সরকারকে এই আইন সংশোধন করার জন্য কিছু সুপারিশসহ চিঠি দিয়েছে। গত ৩১ মার্চ এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, ‘আমি উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি পুনরায় কর্তৃপক্ষের প্রতি অবিলম্বে এর প্রয়োগ স্থগিত এবং এই আইনকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর ধারাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানাচ্ছি।’

তবে সরকার এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিত বা সংশোধনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তবে সম্প্রতি আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই আইন সংশোধন করা হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রীকে নিয়মিত তাগাদা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, অতিসম্প্রতিও আইনমন্ত্রীকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে। এই আইন সংশোধনের বিষয়ে এরই মধ্যে একটি কমিটি করেছে সরকার। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে আইনটি সংশোধন করার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন।

হেনস্তা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা

সংবাদ প্রকাশের জেরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় গত বছরের জুন মাসে গ্রেপ্তার হন একটি জাতীয় দৈনিকের রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক ফজলে এলাহী। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেন রাঙামাটি জেলা মহিলা লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগমের মেয়ে নাজনীন আনোয়ার।

ফজলে এলাহীকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একই আইনে আরেকটি মামলা করেন নাজনীন আনোয়ার। ওই মামলাতেও ফজলে এলাহীকে আসামি করা হয়।

দুটি মামলাতেই ফজলে এলাহী এখন জামিনে আছেন। তিনি গতকাল শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দুটি মামলা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেত্রী। প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে ক্ষোভ থেকেই তাঁকে মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে।

সংবাদ প্রকাশের জেরে গত ২৯ মার্চ ভোরে ঢাকার সাভারে কর্মরত শামসুজ্জামানকে তাঁর বাসা থেকে সিআইডি (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। পরে জানা যায়, তুলে নেওয়ার পৌনে দুই ঘণ্টা আগে তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। আবার তুলে নেওয়ার ১৯ ঘণ্টা পর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। এই মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তুলে নেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন শামসুজ্জামান। আর রমনা থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক এখন জামিনে আছেন।

যারা এখন ক্ষমতায় আছে, তাদের সুরক্ষা দিতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে বলে মনে করেন আর্টিকেল-১৯-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল। তিনি  বলেন, যে আইনে সাংবাদিক, জনগণ—সবাইকে হেনস্তা করার সুযোগ থাকে, সেই আইনের দরকার নেই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.