নতুন করে তদন্ত, জালে অনেক রাঘববোয়াল

0
181

ফরিদপুরে বরকত-রুবেলের দুর্নীতির সিন্ডিকেট

একটি জেলা শহরেও দুর্নীতির কোনো দুষ্টচক্রের জাল কতটা বিস্তৃত হতে পারে, ফরিদপুরের দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল-কাণ্ড এর অন্যতম উদাহরণ। কয়েক বছর ধরেই সংবাদ শিরোনাম হয়ে বারবার আলোচনায় আসেন তাঁরা। দুই সহোদরের মাথার ওপর ছিল দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলা। প্রথম দফার চার্জশিটে গত বছরের মার্চে ১০ জনকে আসামি করে চার্জশিট দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তবে সেই চার্জশিট আদালত গ্রহণ না করে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। দ্বিতীয় দফা তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করেছে সিআইডি। এতে আসামির সংখ্যা হয়েছে চার গুণ। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় আসামি হচ্ছেন অন্তত ৪০ জন। দুই দফার তদন্তে বিস্তর ফারাক। চার্জশিটে রুবেল-বরকত ছাড়াও অনেক প্রভাবশালীর নাম থাকছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে গতকাল এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিআইডির মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ। শিগগিরই চার্জশিট দাখিল করা হবে।
অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার সময় আদালত এই মামলার প্রথম চার্জশিটের বেশ কিছু ভুলের বিষয় সামনে এনেছিলেন। এর পর আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। সেখানে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অধীনে একাধিক আসামি কারও বিরুদ্ধে জবানবন্দি দিলে মামলার অভিযোগপত্র থেকে তাকে বাদ দেওয়ার এখতিয়ার তদন্তকারী সংস্থার নেই। এ ছাড়া রুবেল-বরকত ও তাঁদের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ৪৮৭টি দলিলে ৫ হাজার ৩৮৮ বিঘা জমির কথা উল্লেখ করা হয়, যার মধ্যে ১১৩টি দলিল জব্দ করা হয়। বাকি দলিল তদন্তকারী সংস্থা জব্দ করেনি। অধিকতর তদন্তে পুরোপুরি আদালতের নির্দেশনা মেনে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। দুই ভাইয়ের নামে থাকা ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ২০০ একর জায়গা ক্রোক করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে জব্দ করা বিপুল এই সম্পদ দেখভাল করবেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার। তাঁকে ‘রিসিভার’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

নতুন করে তদন্তে আরও কয়েকশ দলিল জব্দ করা হয়। এ ছাড়া দুই ভাইয়ের আরও সাত-আটটি প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা আগের চার্জশিটে ছিল না। দুই ভাই অবৈধ সম্পদ এবং অর্থ দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য চার্জশিটে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, পরিবহন প্রতিষ্ঠান ও ডেইরি ফার্ম।
একাধিক সূত্র বলছে, মাঠ পর্যায়ের তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের পর্যবেক্ষণ আমলে না নিয়েই সিআইডিসহ পুলিশের তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা এই মামলার দায়সারা চার্জশিট দাখিল করেন। ১৬৪ ধারায় নাম এসেছে এমন ব্যক্তিদের চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। এক ধরনের ‘চাপ’ প্রয়োগ করেই ওই সময় তাড়াহুড়ো করে চার্জশিট দিতে বাধ্য করা হয়। যদিও প্রথম দফার তদন্তে ছয় আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

আলোচিত এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস। তিনি বর্তমানে র‍্যাবে কর্মরত। এই মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে উত্তম কুমার বলেন, তৎকালীন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল। এই মামলায় রুবেল-বরকত দু’জন আসামি ছিলেন। তাঁরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ধীরে ধীরে অনেকের নাম বেরিয়ে আসে। আদালতে প্রথম দফায় চার্জশিট দাখিল করার ব্যাখ্যা দিতে আমাকে ডাকা হয়েছিল। আমি যে ব্যাখ্যা দিয়েছি, তাতে আদালত সন্তুষ্ট হন। এর পর মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। হয়তো এখন সাক্ষ্য-প্রমাণ ও জবানবন্দির ভিত্তিতে আসামির সংখ্যা বাড়ছে।
অপর একটি সূত্র জানায়, প্রথম দফায় যখন মামলাটির চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল, তখন মাঠ পর্যায়ের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সিআইডির তৎকালীন নীতিনির্ধারকদের স্পষ্ট করে বলেন– এ ধরনের অসম্পূর্ণ চার্জশিট আদালতের গ্রহণ করার সম্ভাবনা নেই। তবে ওই পর্যবেক্ষণ আমলে নেয়নি তৎকালীন সিআইডি প্রশাসন। অনেকের অভিযোগ ছিল– কেউ কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অনেক রাঘববোয়ালকে বাদ দিয়েছেন। অধিকতর তদন্তের পর এখন স্পষ্ট– কতটা দায়সারাভাবে এই মামলার তদন্ত শেষ করা হয়েছিল।

নতুন অভিযোগপত্রে যা যুক্ত হচ্ছে
প্রথম দফায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর আদালত ছয়টি কারণ দেখিয়ে ফের এ মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। অধিকতর তদন্তে যাঁরা আসামি হচ্ছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন– সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরী, সাবেক পৌর মেয়র শেখ মাহতাব আলী মেথু, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অনিমেষ রায়, ফরিদপুর চেম্বারের সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক মোকাররম মিয়া বাবু, জেলা শ্রমিক লীগের একাংশের সভাপতি ও জেলা মোটর ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মো. নাছির, জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় সম্পাদক দীপক মজুমদার, ঈশান-গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম মজনু ও কানাইপুরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফকির মো. বেলায়েত হোসেন। তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যক্তি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালতের পর্যবেক্ষণের আলোকে তাঁদের নাম চার্জশিটে থাকছে। তাঁদের মধ্যে নাছিরের মাদক কারবারিদের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী আছে তাঁর। এ ছাড়া ঈশান-গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম মজনুর বিরুদ্ধে মাদক-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর বাইরে আরও অনেকে চার্জশিটভুক্ত হতে পারেন। তাঁরা হলেন– ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি কেনাকাটা নিয়ে কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সাজ্জাদ হোসেন বাবু, ঠিকাদার খন্দকার শাহিন ওরফে পান শাহিন, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা সাহেব সরোয়ার, ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র অমিতাভ বোস, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জীবন, সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের তৎকালীন এপিএস অ্যাডভোকেট সত্যজিৎ মুখার্জি, ব্যবসায়ী আজমল হোসেন খান ওরফে ছোট আজম, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা খলিফা কামাল উদ্দিন, খাবাসপুরের ব্যবসায়ী  জামাল মিয়া, সাবেক কাউন্সিলর নাজিফুল ইসলাম তাপস, সাবেক যুবলীগ নেতা চৌধুরী হাসান ও বরকত-রুবেলের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হারুন মণ্ডল। জামাল ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের তৎকালীন এপিএস এএইচএম ফোয়াদের ঘনিষ্ঠ সহচর।

প্রথম অভিযোগপত্রে যাঁরা আসামি
বরকত-রুবেল ছাড়া প্রথম দফার অভিযোগপত্রের অন্য আসামিরা হলেন– ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, আসিকুর রহমান ফারহান, খন্দকার মোহ্‌তেশাম হোসেন বাবর, এএইচএম ফোয়াদ, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ওরফে ফাহিম, কামরুল হাসান ডেভিড, মুহাম্মদ আলী মিনার ও তারিকুল ইসলাম ওরফে নাসিম। ২০২০ সালের ২৬ জুন রাজধানীর কাফরুল থানায় অর্থ পাচারের অভিযোগে বরকত ও রুবেলের বিরুদ্ধে সিআইডির পরিদর্শক এসএম মিরাজ আল মাহমুদ বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধনী-২০১৫-এর ৪(২) ধারায় এ মামলা করা হয়। এজাহারে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ফরিদপুরের এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন বরকত-রুবেল। এ ছাড়া মাদক কারবার, ভূমি দখল করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাঁরা। এসি, নন-এসিসহ ২৩টি বাস, ট্রাক, বোল্ডার, পাজেরো গাড়ির মালিক হয়েছেন। টাকার একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেন দুই সহোদর। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ মামলায় এ দুই ভাইয়ের নাম বেশি প্রচার পায়।

২০২০ সালের ১৬ মে রাতে ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মোল্লাবাড়ী সড়কে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৮ মে সুবল সাহা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। পরে ৭ জুন রাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানে ওই মামলার আসামি হিসেবে শহরের বদরপুরের আফসানা মঞ্জিলসহ বিভিন্ন মহল্লায় অভিযান চালিয়ে বরকত ও রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.