দেশীয় ব্র্যান্ডের আসবাবের ব্যবসা বাড়ছে, রপ্তানিতে সম্ভাবনা

0
194

বর্তমানে দেশে আসবাবের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। বাকিটা নন-ব্র্যান্ডেড প্রতিষ্ঠানের হাতে।

একসময় মানুষ পরিচিত কাঠমিস্ত্রি বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নিজের বাসাবাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় খাট-পালঙ্ক, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি আসবাব বানাত কিংবা তাঁদের কাছ থেকে কিনে নিতে। সেই জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে ব্র্যান্ডের আসবাব। নকশায় নান্দনিক, মানে উন্নত আর টেকসই হওয়ায় দেশে এরই মধ্যে ব্র্যান্ডের আসবাবের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। আবার এসব আসবাব জনপ্রিয় হওয়ায় আমদানি কমে আসছে।

করোনাকাল বাদ দিলে দেশে ব্র্যান্ডের আসবাবের ব্যবসা বছরে ১৫-২০ শতাংশ বাড়ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়েছে। দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিক্রিও কমেছে। এতে কঠিন সময় পার করছে আসবাব খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে অবশ্য আসবাব রপ্তানি বাড়ছে; কিন্তু বৈশ্বিক আসবাব রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা খুবই নগণ্য।

আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে আসবাব খাতের সম্ভাবনা অনেক। এ জন্য সরকারকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে। উদ্যোক্তাদের নীতি সহায়তা দিতে হবে। কাঁচামাল আমদানিতেও শুল্কছাড় প্রয়োজন। ফলে দেশের বাজারে ব্র্যান্ডের আসবাবের ব্যবসা বাড়বে।

উদ্যোক্তারা আসবাবের কাঁচামাল আমদানিতে বন্ড সুবিধা দাবি করেছেন। তা হলে বিশ্ববাজারে আসবাবের রপ্তানি বাড়বে বলে তাঁরা মনে করেন। উদ্যোক্তারা বলেন, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩২ হাজার ৮৬৪ কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়। ফলে আসবাবকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্যে পরিণত করা সম্ভব।

প্রায় চার দশক আগে ব্র্যান্ডের আসবাবের সঙ্গে দেশের মানুষকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় অটবি। তারপর আসে আখতার ও হাতিল ব্র্যান্ড। এরপর দিনেদিনে ঘর বাড়ির পাশাপাশি অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবাবের চাহিদা বাড়তে থাকে। এই চাহিদা কাজে লাগাতে নাভানা, পারটেক্স, ব্রাদার্স, নাদিয়া, হাইটেক, রিগ্যাল, ইশো ও বহুর মতো নতুন নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠেছে। তবে নন-ব্র্যান্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতেই আসবাবের বড় বাজার রয়ে গেছে বলে জানায় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো।

জানা যায়, বর্তমানে দেশে আসবাবের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার। তার মধ্যে ৩৫ শতাংশ ব্র্যান্ডের দখলে। বাকিটা নন-ব্র্যান্ডেড প্রতিষ্ঠানের হাতে। দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে আসবাব প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। তার মধ্যে স্বীকৃত ব্র্যান্ড আছে ১০০টির কাছাকাছি। আর এই খাতে কাজ করেন ২০-২৫ লাখ মানুষ।

বেড়েছে দাম, ঈদে ছাড়

দেশে আসবাব খাতের প্রসারের পাশাপাশি কাঁচামালের আমদানিও বেড়েছে। এর কারণ কাঠ, সরঞ্জাম ও রাসায়নিকসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল আমদানিতে গড় শুল্কের পরিমাণ ৫২ থেকে ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে কাঠ আমদানিতে ১০ থেকে ৩৭ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এ ছাড়া বোর্ড, কাচ, চামড়া, ফোমসহ বিভিন্ন উপকরণ আমদানিতে প্রায় ৮৯ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, আসবাব তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। গত এক বছরে টাকার মান কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ দশমিক ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১০৯ টাকা হয়েছে। এতে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়েছে। তবে বিক্রি কমে যেতে পারে সেই আশঙ্কায় বাড়তি ব্যয় পণ্যের দামের সঙ্গে সেভাবে সমন্বয় করা যায়নি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো আসবাবের দাম ৫-৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ছোটরা তা করতে পারেনি।

এদিকে পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে হাতিল, ব্রাদার্স, নাদিয়া, রিগ্যাল ও অটবিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়ে বিভিন্ন ধরনের আসবাব বিক্রি করছে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ক্রেতারা আসবাব কেনার ক্ষেত্রে মূল্যছাড় পাবেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্পমালিক সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ এ এস এম নূর উদ্দীন বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আসবাব উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। কিন্তু আসবাব আমাদের দেশে বিলাসী পণ্য। তাই হঠাৎ করে খরচ সমন্বয় করা যায় না। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে গত জানুয়ারি থেকে বিক্রি ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে। ফলে আসবাব খাতের ব্যবসায়ীরা খুবই শোচনীয় অবস্থায় রয়েছেন। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদে সাধারণত খুব একটা ব্যবসা হয় না। তবে বর্তমানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কিছু বিক্রির আশায় সব প্রতিষ্ঠানই মূল্যছাড় দিয়েছে। এর ফলে বিক্রিতে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সম্ভাবনা থাকলেও রপ্তানি কম

গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে আসবাব রপ্তানি বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। দীর্ঘদিন ধরে আসবাব রপ্তানি ছয়-সাত কোটি ডলারের মধ্যে ছিল। গত ২০২১–২২ অর্থবছরে পণ্যটির রপ্তানি ১০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। যদিও আসবাবের বৈশ্বিক বাজারের তুলনায় সেটি খুবই কম।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩ কোটি ১৪ লাখ ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়েছিল। গত অর্থবছর সেটি বেড়ে ১১ কোটি ৪ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর ৫০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে, ১৬ শতাংশ জাপানে ও ৯ শতাংশ ফ্রান্সে রপ্তানি হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ থেকে ৬১টি দেশে আসবাব রপ্তানি হয়।

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ৩২ হাজার ৮৬৪ কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি করে। এর মধ্যে চীন সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বা ১৩ হাজার ৯৪৮ কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি করেছে। গত ১০ বছরে চীনের রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশ। চীনের পর সবচেয়ে বেশি আসবাব রপ্তানি করেছে জার্মানি, যা পরিমাণে ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলার। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক ভিয়েতনাম। দেশটি রপ্তানি করেছে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ডলারের আসবাব। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনকে টপকে শীর্ষ আসবাব রপ্তানিকারক হয়েছে ভিয়েতনাম। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৭৪০ কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি করেছে দেশটি।

রপ্তানি বাড়াতে করণীয় কী

আসবাবের বৈশ্বিক বাজার ৬৫ হাজার কোটি ডলারের। সরকার যথাযথ নীতি সহায়তা দিলে বাংলাদেশ থেকে আসবাব রপ্তানি খুব অল্প সময়ে ১০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ বর্তমানে ৩৮টি দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু কাঁচামালের উচ্চ আমদানি শুল্কের কারণে দেশের আসবাবশিল্পের রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না; বরং উচ্চ শুল্কের কারণে রপ্তানিবাজারের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে যাচ্ছে খাতটি। গত বছর বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্পমালিক সমিতির চেয়ারম্যান ও হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান গতকাল বুধবার বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং বিক্রি কমে যাওয়ায় কঠিন সময় পার করছে আসবাব খাত। মুনাফা নয়, ব্যবসায়ে টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চ্যালেঞ্জে টিকতে না পেরে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংকট দীর্ঘ হলে আসবাব খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহায়তা লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আসবাব রপ্তানির বিষয়ে সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘আসবাব রপ্তানিতে বড় সাফল্য পেতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে। আমাদের তৈরি করা আসবাবের মান উন্নত হলেও আমরা প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দামের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। এর কারণ দেশে কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা আছে। এর বিপরীতে আমাদের ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পর নগদ সহায়তা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে এখনই বিকল্প চিন্তা করতে হবে।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.