যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির কারণে দেশের সিভিল প্রশাসনে এক শ্রেণির কর্মকর্তার মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা অবসর শেষে আমেরিকা, ইউরোপ ও কানাডায় থিতু হতে চান, চিন্তা ঢুকেছে মূলত তাঁদের মধ্যে। এ ছাড়া নির্বাচনকালে ডিসি ও ইউএনও রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাঁদের মধ্যেও এক ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রশাসনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। যদিও নাম প্রকাশ করে কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি।
গত ২৪ মে এক টুইট বার্তায় বাংলাদেশ সম্পর্কিত ভিসা নীতির ঘোষণা দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভিসা নীতিতে যে বার্তা দিয়েছে তাতে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বেশি ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, রাজনীতিকরা রাজপথ, ক্ষমতার মসনদ এবং জেলখানা– সব জায়গাতেই অভ্যস্ত। প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় সরকারের অধীনে দায়িত্ব পালন করলেও থাকতে চান নিরাপদে। সেখানে এই ভিসা নীতি এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যাঁরা বাধা দেবে, তাঁদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কোনো কোনো আলোচনায় এটাকে সতর্কবার্তা হিসেবে না দেখে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার চেয়েও কড়া পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও নির্বাচন নিয়ে অসচ্ছতার মধ্যে থাকা একাধিক দেশের সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু কাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। বাংলাদেশেও এমনটা করা হলে সেটাও হয়তো জানার উপায় থাকবে না।
কর্মকর্তারা বলছেন, ভিসা নীতি যদি শুধু একটি দেশের জন্য প্রযোজ্য হতো, তাহলে সেটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কারণ থাকত না। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, উন্নত অধিকাংশ দেশই আমাদের ভিসা দেবে না। এমনকি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো নিয়ে নতুন করে দুশ্চিন্তা কাজ করছে এখন। কারণ বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ক্ষেত্রে ভিসা নীতি প্রয়োগ করলে সেটা কমবেশি অনুসরণ করে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলো।
সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ইউএনও এবং ডিসিরা। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল ঢাকায় পাঠানো হয়। তাই কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করবেন, এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের দুর্ভাবনা কাজ করছে। তবে কেউ কেউ এমনও বলছেন, মাঠ প্রশাসনে কাজ করা সব সময়ই চ্যালেঞ্জের বিষয়। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের নীতি বাস্তবায়ন করতে হয়। বিধিবিধান মেনে সরকারের নির্দেশ পালন করতেই হয়। ভিসা নীতি নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সতর্কতা আরও বাড়াবে।
উত্তরবঙ্গের একটি উপজেলার শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে সিনিয়র-জুনিয়র সব পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। স্বাভাবিক কর্মকাল অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকতে হবে। এরই মধ্যে আত্মীয়স্বজন খোঁজখবর নেওয়া শুরু করছেন নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে কিনা। জুনিয়র কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বরিশালের একটি উপজেলার ইউএনও বলেন, আমাদের পর্যায় থেকে এগুলো চিন্তা করার দরকার নেই, কারণ আমাদের সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে।
কিশোরগঞ্জের সাবেক ডিসি ফিরোজ মিয়া অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গেছেন। তিনি বলেন, ভিসা নীতি মাঠ প্রশাসনে বড় প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে হয় না। জুনিয়র কর্মকর্তাদের ওপরের নির্দেশ পালন না করলে চাকরি, পোস্টিং নিয়ে তাৎক্ষণিক বিপদে পড়তে হয়। তবে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে যাঁরা বিদেশমুখী আছেন, তাঁদের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে।
কয়েকটি জেলার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। তাঁদের একজন মনে করেন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নানাবিধ স্বার্থ থাকে শক্তিধর রাষ্ট্রের। তাদের কৌশল পুরোটা বোঝাও মুশকিল।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর সচিবালয়েও এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দুই ধরনের টেনশন কাজ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর পর্যবেক্ষণ। তারা বলছে, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনেকের সন্তান অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পড়াশোনা করছে বা করার চিন্তা আছে। কেউ কেউ অবসরের পর পরিবার নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায়ও আছেন। এ কারণে তাঁরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। অন্যদিকে, মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সুযোগে বিদেশ সফর, বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনার জন্য প্রথম পছন্দ এসব দেশ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে তাঁদেরও উদ্বেগ আছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি খরচ বা অন্য ফান্ডে বিদেশে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণে যাওয়া বেশিরভাগ কর্মকর্তার গন্তব্য ইউরোপ–আমেরিকা। ‘বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পিএইচডি ফেলোশিপ, মাস্টার ফেলোশিপ, বিভিন্ন শর্ট কোর্সের জন্য মধ্যম ও শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ৮০ শতাংশের বেশি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এ ছাড়া পছন্দের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও সুইডেনের মতো দেশগুলো।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের ছয় সংসদ সদস্য, যুক্তরাষ্ট্রের ১২ আইনপ্রণেতা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উদ্বেগ জানিয়েছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে শান্তিরক্ষা মিশন বিবেচনার জন্য।
সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি। অনেকে এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায়ও অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে যাঁরা নিজেদের কাজের বাইরে দলবাজিতে সক্রিয় নন, অতীতে নেতিবাচক কাজের নজির প্রায় নেই, সেসব কর্মকর্তা অনেকটাই নির্ভার। তাঁদের অভিমত, ইউরোপ-আমেরিকার স্বপ্ন তাঁদের নেই। সন্তানরা যদি নিজেদের যোগ্যতায় যেতে পারে, সেটা তাদের বিষয়। আর নিজেদের কাজের খারাপ রেকর্ডের জন্য কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তাঁরা পড়বেন বলে মনে করেন না। কারণ তেমন কাজ অতীতে করেননি, ভবিষ্যতেও করবেন না।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, কোথায়, কী পদক্ষেপ নিলে কেমন কাজ হবে, সেটা যুক্তরাষ্ট্র খুব ভালোভাবে জানে। তাই যে যাই বলুক, এ ভিসা নীতির প্রভাব প্রশাসনে পড়ছে–এ কথা মুখ ফুটে কেউ বলতে পারবেন না। কিন্তু কাজের মাধ্যমে সেটা প্রকাশ হয় কিনা, সেটা বুঝতে সময় লাগবে।