বিদেশে বাড়ি–গাড়ি কেনেননি, সেখ আকিজ উদ্দিন ঋণখেলাপিও ছিলেন না

0
315
আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ‘শেখ আকিজ উদ্দিন: জীবন ও সময়’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি, আকিজ উদ্দিনের পরিবারের সদস্য ও বিশিষ্টজনেরা। গতকাল বিকেলে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে

আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিনকে নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে গতকাল। বণিক বার্তা বইটি প্রকাশ করেছে।

দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সেখ আকিজ উদ্দিন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে দাঁড়িয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তৈরি করেছেন নিজের মতো একটা পথ। একটা সময় ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা করেছেন। তবে তিনি নিজে ভোগ করতেন কম। ব্যবসায়ী হিসেবে ছিলেন সাহসী, খরচের ক্ষেত্রে ছিলেন সংযমী। এই ব্যবসায়ী তাঁর সব সম্পদ দেশে বিনিয়োগ করেছেন। বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কেনেননি, এমনকি ছিলেন না ঋণখেলাপিও।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল শনিবার শেখ আকিজ উদ্দিন : জীবন ও সময় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বক্তারা। বইটি প্রকাশ করেছে ব্যবসা–বাণিজ্যবিষয়ক দৈনিক বণিক বার্তা। অনুষ্ঠানে সেখ আকিজ উদ্দিনের পরিবারের সদস্যরাসহ দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, ব্যাংকার, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বক্তব্য দেন।

যশোরের একটা গ্রাম থেকে এসে উনি দেশের পণ্য বিতরণব্যবস্থার চিত্র পাল্টে দিয়েছেন। ভোগ্যপণ্য বানাতেন, তবে ভোগে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, তবে কৃপণ ছিলেন না।সেখ বশির উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আকিজ-বশির গ্রুপ

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, ‘সেখ আকিজ উদ্দিন ছিলেন আমার এলাকার মানুষ। ছোটবেলা থেকেই ওনার সম্পর্কে জেনেছি। উনি বড় ব্যবসায়ী হয়েও খুব সাধারণ জীবন যাপন করেছেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি সফল ছিলেন। নতুন উদ্যোগ নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন।’

অনুষ্ঠান আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘যশোরের একটা গ্রাম থেকে এসে উনি দেশের পণ্য বিতরণব্যবস্থার চিত্র পাল্টে দিয়েছেন। ভোগ্যপণ্য বানাতেন, তবে ভোগে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন, তবে কৃপণ ছিলেন না। আমেরিকান এক চিকিৎসক ওনাকে দেখতে দুবার ঢাকায় এসেছেন। গভীর সম্পর্কের কারণেই তিনি এ দেশে এসেছিলেন।’

বশির উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমরা ১০ ভাই, ৫ বোন। সবাই বাবার আদর্শকে লালন করার চেষ্টা করি। আমি আমার বড় ভাইয়ের সামনে কখনোই উঁচু গলায় কথা বলি না। এই শিক্ষা আব্বা আমাদের দিয়েছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমার বন্ধুরা যখন ঘুরতে গেল। আব্বা তখন আমাকে ডেকে বললেন, সময় নষ্ট না করে ব্যবসায় সময় দাও। মাত্র ১৭ বছর বয়সে আব্বার সঙ্গে কাজ শুরু করি। আমার প্রথম বেতন ছিল মাত্র তিন হাজার টাকা।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, দেশ থেকে শুধু অর্থ পাচার হচ্ছে না, উদ্যোক্তা-মেধা—এসবও পাচার হয়ে যাচ্ছে। আকিজ উদ্দিনের মতো উদ্যোক্তা এখন আর দেশে দেখা যাচ্ছে না। তিনি ব্যবসায় যেমন সৎ ছিলেন, তেমনি ছিলেন সাহসী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক পরিচালক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার বলেন, একজন ব্যবসায়ী, যাঁর দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জেলে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি; বরং এগিয়ে গেছেন। শুধু ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, একজন মানবিক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে সেখ আকিজ উদ্দিনের ছেলে আমিন উদ্দিন বলেন, ‘একবার ব্রিটিশ এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে একটা মিলের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য আব্বা আমাকে বলে দিলেন ১৫ লাখ ডলার দাম দিতে। কিন্তু আমি সেটা দামাদামি করে ১৪ লাখ ডলারে কিনেছিলাম। এ কথা আব্বাকে জানানোর পর তিনি দেশের ডলার কম খরচ হওয়ায় খুবই খুশি হন।’

আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের টাকা কেন দেশে থাকছে না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। আনোয়ার হোসেন বা আকিজ উদ্দিন চাচার মতো ব্যবসায়ীরা দেশে বিনিয়োগ করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন।’

অনুষ্ঠানে আবদুল মোনেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মাঈনুদ্দিন মোনেম বলেন, ‘বড় মানুষেরা একই কাজ আলাদাভাবে করে থাকেন। আকিজ চাচা, আনোয়ার চাচা কিংবা আমার বাবা—তাঁরা সেই কাজ করে দেখিয়েছেন।’

অর্থনীতিবিদ মামুন রশীদ বলেন, এখনকার উদ্যোক্তা-শিল্পপতিদের নিয়ে ব্যাংকগুলো চিন্তায় থাকে, কোন ব্যবসায়ী কখন ঋণখেলাপি হয়ে যান। সেখানে আকিজ উদ্দিন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বলতেন, ‘টাকা তো ব্যাংকের, আমি এই টাকার পাহারাদারমাত্র।’

বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, ‘প্রকাশিত বইয়ের মাধ্যমে আমরা ওনাকে “হিরো” বা নায়ক বানাতে চাইনি; বরং ওনার উদ্যোক্তা জীবনের নানান দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ও সেখ আকিজ উদ্দিনের পুত্রবধূ জামালুন্নেছা। উপস্থিত ছিলেন স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী নাসের এজাজ বিজয়, এসিআই অ্যাগ্রোলিংকের এমডি এফ এইচ আনসারী, আইপিডিসির এমডি মমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.