রিশাল সিটির নির্বাচনে দলের মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে ইসলামী আন্দোলন সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মুখেও আওয়ামী লীগের বাইরে কয়েকটি দলের অংশগ্রহণে সিটি নির্বাচন যতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল, তা–ও নষ্ট হয়ে গেল। রাজশাহী ও সিলেটের নির্বাচন এখন একেবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে পড়ল। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সিটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।
আওয়ামী লীগের নেতারা ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচন বর্জনকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
পাঁচ সিটির নির্বাচনে একমাত্র বরিশালেই কিছুটা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। সেখানে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম মেয়র প্রার্থী ছিলেন। গতকাল সোমবার বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভোট চলার সময় ফয়জুল করিমের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায় দলটি। তারা ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে গতকালই ঢাকায় বিক্ষোভ করে। ইসলামী আন্দোলন বাকি দুটি সিটি সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।
সিলেট ও রাজশাহীতে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছেন। কিন্তু বরিশালের ঘটনার পর সিলেট ও রাজশাহীতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন নাকি এই দলও ভোট থেকে সরে দাঁড়াবে—এ প্রশ্নে দলটির নেতারা নিজেরা আলোচনা করছেন। জাতীয় পার্টির একজন নেতা জানিয়েছেন, আজ তাঁদের দলের প্রেসিডিয়াম বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ বিভিন্ন দল যখন দুই বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সব পর্যায়ের নির্বাচন বর্জন করে আসছে, তখন ইসলামী আন্দোলন ইউনিয়ন থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছিল। এখন এই দলও সিটি নির্বাচন বর্জন করল। ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তাঁরা আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তাঁর এই বক্তব্যে বরিশালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসলামী আন্দোলনের অবস্থানের পরিবর্তনের বার্তা এল।
এখন এমন অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সৈয়দ রেজাউল করিম বরিশালে তাঁর ভাই এবং দলের মেয়র প্রার্থী ফয়জুল করিমের ওপর হামলার ঘটনাকে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ ছাড়া তিনি অভিযোগ করেন, পাঁচ সিটির নির্বাচনেই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের পক্ষ থেকে সব দলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও মাঠে তার বাস্তবায়ন হয়নি।
যদিও সরকারের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে, এমন সন্দেহ বিএনপিতে ছিল। কিন্তু বরিশালে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বরিশাল ছাড়া অন্য সিটিগুলোর নির্বাচনেও ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় পার্টি ও জাকের পার্টি প্রার্থী দেয়। কিন্তু গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। সেখানে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হন। গতকাল অনুষ্ঠিত দুটি সিটির নির্বাচনে খুলনায় ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু সেখানে তাদের অবস্থান শক্ত না হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেককে কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হয়নি। বরিশালেই ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর অবস্থানের কারণে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল।
সিলেট ও রাজশাহীতে ২১ জুন ভোট হবে। এই দুটি সিটিতে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী রয়েছেন। তবে এখন ইসলামী আন্দোলন এই দুই সিটির নির্বাচন বর্জন করল এবং তাতে সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচন একেবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে পড়ল।
জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির নির্বাচন বিএনপিসহ বিভিন্ন দল বর্জন করলেও ক্ষমতাসীনদের পক্ষ এই নির্বাচনকে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখানোর চেষ্টা ছিল। সেটাও এখন সম্ভব হচ্ছে না।
তবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির বয়কটের কারণে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক থাকে না, সেটি স্বীকার করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনেকে। সে কারণে তাঁরা ইসলামী আন্দোলনের নির্বাচন বর্জনের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চান না। দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বড় দল না থাকায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না। সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে ইসলামী আন্দোলনের মতো দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার রাজনৈতিক শক্তি নেই। ফলে ইসলামী আন্দোলন সিটি নির্বাচনে থাকা না–থাকার বিষয় কোনো গুরুত্ব বহন করে না বলে তিনি মনে করেন।
একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে এটিও বলা হচ্ছে, সিটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে এবং বাকি দুটি সিটি করপোরেশন সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হবে। এ ছাড়া সরকারের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন দাবি করছে, এ পর্যন্ত তিন সিটিতে যে ভোট হলো, তা সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে।
কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে। সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসলামী আন্দোলনের অংশগ্রহণ থাকার সময়ও এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না। এখন তারাও এই ভোটে না থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, সিটির এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনোটাই হয়নি। ফলে প্রতিযোগিতা না থাকায় নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি না, সেই প্রশ্ন গুরুত্ব পাচ্ছে না।
এখন সিটির নির্বাচনকে যেহেতু অংশগ্রহণমূলক বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, কোনোটাই বলা যাচ্ছে না, এমন পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।