ক্রিকেটারদের মনোজগৎ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ দলে আগেও এসেছেন, ভবিষ্যতেও আসবেন। তবে অ্যালান ব্রাউনের কাজটা একটু ভিন্ন।
কার মধ্যে কী আছে, দেখে তো আর সব সময় বোঝা যায় না। দেখে যেটা মনে হয়, অনেক সময় পরে গিয়ে দেখা যায়, সেই মনে হওয়াটা ছিল ভুল। তত দিনে সময় তো নষ্ট হয়ই, দিতে হতে পারে ভুল মানুষকে ঠিক মানুষ ভেবে করা ভুলের মাশুলও। বিসিবি তাই এগোতে চায় পরিকল্পিত উপায়ে, যাতে আলো ফেলার টর্চটা আপাতত অ্যালান ব্রাউনের হাতে। সেই আলোয় বিসিবি খুঁজবে ভবিষ্যতের নেতাও।
ব্রাউন স্কটিশ বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান, পেশায় মাইন্ড ট্রেনার। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মনোজগৎ নিয়ে দুই সপ্তাহ কাজ করার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তিনি এখন দলের সঙ্গে। ব্রাউনের কাজের শুরুটা হয় মানুষের মনের বারান্দায় উঁকি দিয়ে ভেতরের সাজসজ্জা দেখে। এরপর ওই মানুষকে তিনি বলে দেন, ‘তোমার মনটা এভাবে নয়, ওভাবে সাজাও।’ আবার কারও মনে তিনি খুঁজে পান শক্তির অবারিত উৎস, যেটাকে উসকে দিয়ে সেই শক্তিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালান অন্যদের মধ্যে।
পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় হতে যাচ্ছে এশিয়া কাপ
ক্রিকেটারদের মন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ দলে আগেও এসেছেন, ভবিষ্যতেও আসবেন। এই যেমন ব্রাউন যাওয়ার পর আগস্টে দুই সপ্তাহের জন্য আসার কথা এর আগেও বাংলাদেশে কাজ করে যাওয়া মনোবিদ ফিল জোনসির। তবে ব্রাউনের সঙ্গে তাঁর কাজের মৌলিক পার্থক্য থাকবে। জোনসি কাজ করবেন খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত মানসিক দুর্বলতা দূর করতে। আর ব্রাউনের কাজ হচ্ছে প্রত্যেকের মনের জানালায় উঁকি দিয়ে দলের অন্দরমহলটাকে একই সাজে সাজিয়ে তোলার নকশা এঁকে দেওয়া এবং সেটা এই দলের ক্রিকেটারদের মনে ছড়িয়ে থাকা অণু-পরমাণু কাজে লাগিয়েই।
দলে কেউ হয়তো এমনই আত্মবিশ্বাসী, কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই সাহস হারান না। কারও মধ্যে সহমর্মিতার মনোভাব প্রবল। আবার কেউ হতে পারেন খুব সুশৃঙ্খল, কারও মধ্যে থাকতে পারে প্রখর নেতৃত্বগুণ। ব্রাউনের কাজ হলো এই মানসিক শক্তিগুলোকে দলের মধ্যে ছোঁয়াচে করে দেওয়া। যেন একজনের মনের আলোয় আরেকজন আলোকিত হয়ে ওঠেন।
তামিম ইকবালের জন্য অপেক্ষা
ব্রাউনের সঙ্গে দুটি সেশন করে দলের এক ক্রিকেটারও সে রকমই বুঝেছেন বলে মনে হলো, ‘তিনি মূলত কাজ করছেন আমরা যেন একজন আরেকজনকে আরও বেশি করে বুঝতে পারি, সেটা নিয়ে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের আচরণ তখন সেভাবে হবে। ধরুন, আমার এক সতীর্থ মানসিকভাবে একটু দুর্বল, আমি তখন প্রয়োজনে তাকে উজ্জীবিত রাখতে চেষ্টা করব। এভাবে প্রত্যেকে নিজের ভালোটা দিয়ে অন্যকে সাহায্য করবে।’
মনের মাটি খুঁড়ে গভীরে লুকিয়ে থাকা খনিজের সন্ধান করতে ব্রাউন প্রত্যেক খেলোয়াড়ের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন একটি করে প্রশ্নপত্র, যেখানে প্রশ্নের সংখ্যা শতাধিক। খেলোয়াড়দের কাছ থেকে পাওয়া এসব প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করে মনবিশেষজ্ঞ ব্রাউন মোটামুটি বুঝে যাবেন, কে কতটা সহনশীল, কার ধৈর্য-আত্মবিশ্বাস বেশি, কে আলতো বাতাসে ভেঙে পড়েন, কে প্রবল বাতাসেও নুয়ে পড়েন না, কে সুশৃঙ্খল, কার জীবনে সেটার ঘাটতি, কার আছে অন্যকে শেখানোর ক্ষমতা, কার মধ্যে লুকিয়ে নেতৃত্বগুণ—এ রকম আরও অনেক কিছু, যা দিয়ে সহজেই এঁকে ফেলা যায় একজন মানুষের মনের মানচিত্র। যেটাকে বলা হচ্ছে ‘মাইন্ড প্রোফাইল’, আর ব্রাউনের কাজের এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘গ্যালাপ স্ট্রেংথ’।
‘সেরা’ প্রস্তুতি নিতে না পেরে তামিমের ভরসা মানসিক প্রস্তুতি
ব্রাউনের ‘প্রোফাইল’ ব্যবহার করে চলবে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত মানসিক শক্তি দলের মধ্যে প্রবাহিত করার কাজ, দুর্বল মানসিকতার ওপর সবল মনের আলো ফেলে পিছিয়ে থাকাদের সামনে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া, যেটা আসলে এই আফগানিস্তান সিরিজেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর আছে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য।
আফগানিস্তান টেস্টের মাঝামাঝি কাজ শেষ করে চলে যাবেন ব্রাউন। তবে অনলাইনে যোগাযোগ রাখবেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে। আর যাওয়ার আগে খেলোয়াড়দের মনের মানচিত্রগুলো (প্রোফাইল) দিয়ে যাবেন বিসিবিকে। সেগুলো নিয়ে বিসিবি, কোচিং স্টাফ ও বাংলাদেশ দল আঁকবে ভবিষ্যতের পথরেখা।
বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান জালাল ইউনুস সেই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বেশ আশাবাদী, ‘বড় দলগুলো এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে এবং ভালো ফল পেয়েছে। ব্রাউন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের সঙ্গেও কাজ করেছেন। খেলোয়াড়দের মাঠের পারফরম্যান্সে উন্নতি আনতে আমাদেরও এটা দরকার ছিল। আমরা তাহলে আগে থেকেই বুঝতে পারব, কার মানসিকতা কেমন, বিশেষ করে কাদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ আছে। এসব সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা থাকলে সুবিধা।’
দর্শনদারিতে গুণবিচার খেলাধুলায় থাকবেই। তার সঙ্গে মনোবিজ্ঞান যোগ হয়ে বিচারপ্রক্রিয়া আরও নির্ভুল হবে, এমন আশা তো জাগেই।