সারাদেশে ২ হাজার ১৫২ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক ভাঙাচোরা। তা দেশের সড়ক-মহাসড়কের ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের বছর ভাঙাচোরা রাস্তা ছিল ২ হাজার ৭৭ কিলোমিটার। সারাদেশে ১৫ হাজার ৪৬৪ কিলোমিটার অর্থাৎ ৭৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ভালো। আগের বছরে ভালো ছিল ৭৬ দশমিক ২৫ শতাংশ রাস্তা।
এই হিসাবে সড়কে খুব একটা অবনতি না হলেও, এক বছরে উন্নতি হয়নি। ৩৭৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ, চলাচলের অযোগ্য। আগের বছরে এমন রাস্তা ছিল ৪৫৭ কিলোমিটার। ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামত ও ভালো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে আগামী পাঁচ বছরে ২১ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা প্রয়োজন। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে লাগবে ৯ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মহাসড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (এইচডিএম) বিভাগের প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জরিপ করে ২০২২-২৩ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সওজের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইসহাকের দাবি, সড়কের অবস্থার অবনতি হয়নি। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৪৫২ কিলোমিটার সড়ক সওজের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেগুলো বেহাল হওয়ায় জরিপ প্রতিবেদনে ভালো সড়কের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। সেগুলো রুটিন কাজের মাধ্যমে সচল রাখা হয়েছে।
সারাদেশে সওজের ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজার ৫২৩ কিলোমিটারের রাফনেস জরিপ করা হয়েছে। জরিপে ভালো, মোটামুটি, নাজুক, খারাপ ও খুব খারাপ– এই পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে সড়ক মহাসড়ককে।
সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব রাস্তা খুব খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো আসলে যান চলাচলের উপযোগী নয়। এ হিসাবে ৩৭৭ কিলোমিটার সড়ক যান চলাচলের অনুপযুক্ত। ২০২১ সালের জরিপে এমন সড়ক ছিল ৬৯১ কিলোমিটার। এর আগের বছরে ছিল ৯৪৩ কিলোমিটার। ২০১৯-২০ সালের জরিপে খুব খারাপ সড়ক ছিল প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার।
চলাচল অনুপযোগী সড়ক প্রায় ৭৫ শতাংশ কমেছে গত চার বছরে। যদিও গত বছর সওজের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মনির হোসেন পাঠান দাবি করেছিলেন, যেসব প্রকল্প চলমান, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে তিন বছর পর ভালো সড়কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৮ শতাংশ। কিন্তু তা না হয়ে ভালো সড়কের পরিমাণ কমে যাওয়ার ব্যাখ্যায়
বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী বলেছেন, সড়কের কোথাও একটি গর্ত, ভাঙা কিংবা রাউটিং (ফুলে যাওয়া) থাকলে পুরো ১০০ মিটার রাস্তাকে খারাপ ধরা হয়। রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা নেই জানিয়ে মোহাম্মদ ইসহাক বলেছেন, সরকার টাকা দিচ্ছে। কিন্তু রাস্তা বেড়েছে।
সওজের প্রতিবদেন অনুযায়ী, ৩ হাজার ৯৪৪ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ৪ হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১১ হাজার ৫৯৫ কিলোমিটার জেলা সড়ক জরিপ করা হয়েছে। বাকি সড়ক জরিপ করা হয়নি উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে।
চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ জাতীয় মহাসড়কের ৩ হাজার ৯৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ২ হাজার ৯৫১ কিলোমিটারের অবস্থা ভালো। তা জরিপ করা মহাসড়কের ৭৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের জরিপে ভালো মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ২ হাজার ৯৫৭ কিলোমিটার বা ৭৫ দশমিক ৮৩ শতাংশের অবস্থা ভালো। অর্থাৎ ১ শতাংশ কমেছে ভালো জাতীয় মহাসড়ক। জাতীয় মহাসড়কের ৭০৬ কিলোমিটারের বা ১৭ দশমিক ৯ শতাংশের অবস্থা মোটামুটি। বাকি প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার ভাঙাচোরা। আগের বছরে ভাঙাচোরা জাতীয় মহাসড়ক ছিল ২৭৪ কিলোমিটার।
আগের বছরগুলোর মতো এবারের জরিপেও দেখা গেছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জেলা সড়কের। জরিপের আওতায় জেলা সড়কের মধ্যে ৮ হাজার ৭৫০ কিলোমিটারের অবস্থা ভালো। ১ হাজার ৬৩৩ কিলোমিটারের অবস্থা মোটামুটি। ১ হাজার ৫১২ কিলোমিটার ভাঙাচোরা। এর মধ্যে ২৬০ কিলোমিটার জেলা সড়ক গাড়ি চলাচলের অনুপযুক্ত। জরিপের আওতায় আসা আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে ৩ হাজার ৭৬২ কিলোমিটার বা ৮০ দশমিক ৩৪ শতাংশের অবস্থা ভালো।
সারাদেশে ১০টি জোনে বিভক্ত সওজ। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সড়কের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। চট্টগ্রামের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এই জোনে ৩৬১ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। এর মধ্যে ৪০ কিলোমিটার চলাচলের অনুপোযোগী।
গত ১৪ বছরে যোগাযোগ খাতে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে সড়কের জন্য ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগকে ৩৫ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে সড়কের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে।
যোগাযোগ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত বিপুল বিনিয়োগের পরও সড়কের ১০ শতাংশ ভাঙাচোর থাকা অগ্রহণযোগ্য। নতুন সড়ক নির্মাণের চেয়ে পুরনোগুলো রক্ষণাবেক্ষণে মন দিতে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে মেরামত ও পুনর্নির্মাণ টেকসই না হওয়ার বিষয়ে সওজ প্রকৌশলীরা বলেছেন, এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল, অতিরিক্ত যান চলাচল ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সড়ক ভেঙেচুরে যায়। গত বছরের বন্যায় সিলেট বিভাগ ও উত্তরবঙ্গের সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এবারের বর্ষায় তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন প্রধান প্রকৌশলী। বৃষ্টি হলেও এবারের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন হবে বলে দাবি করেছেন তিনি।