চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে উপকূলের বেড়িবাঁধের দুই পাশে ঘন কেওড়া বন। পার হলে দেখা যায়, সদ্যনির্মিত একটি কাঁচা সড়ক চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। সড়কটি তৈরি করা হয়েছে গাছ কেটে। সড়কটির শেষপ্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুটি পাকা ভবন।
এই ভবন দুটি কোহিনূর স্টিল নামের একটি জাহাজভাঙা কারখানার। গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন থেকে তারা এখানে পাঁচ একর জমি ইজারা পায়। তবে এই ইজারায় শুরু থেকেই বনবিভাগের আপত্তি ছিল। আশপাশের মতো এখানেও উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী ছিল। কিন্তু ইজারা পাওয়ার আগে ও পরে জেলা প্রশাসনের ‘উদারতায়’ ধীরে ধীরে পাঁচ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়।
চট্টগ্রামের বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ১ জুন কোহিনূরের ইজারা বাতিল করেন। ইজারা বাতিলের দুই দিন আগে ইয়ার্ডে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়।
কোহিনূর স্টিলকে বনভূমি ইজারা দেওয়ার সময় চট্টগ্রামের ডিসি ছিলেন মো. মমিনুর রহমান। তিনি বর্তমানে ঢাকা জেলার ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বন বিভাগের দাবি, তাদের আপত্তি আমলে নেননি তৎকালীন ডিসি মমিনুর।
এর আগে ২০১৯ সালে একই জায়গায় ৭ দশমিক ১০ একর ভূমি ইজারা দেওয়া হয়েছিল আবুল কাসেম ওরফে রাজা কাসেম নামের এক ব্যক্তির কাছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই ইজারা বেআইনি ঘোষণা করেন। এরপর আবার একই জায়গাকে ভিন্ন মৌজা দেখিয়ে কোহিনূর স্টিলকে ইজারা দেওয়া হয় বলে বন বিভাগের অভিযোগ। কোহিনূরের মালিক আবুল কাসেমের স্ত্রী কোহিনূর বেগম।
নতুন ইজারার বিষয়টি আদালতের নজরে এনে আদালত অবমাননার অভিযোগ করে বেলা। এরপর আদালতে এ বিষয়ে দুই সপ্তাহের সময় প্রার্থনা করেন রাষ্ট্রপক্ষ। পরে ইজারা বাতিল করা হয়।
জানতে চাইলে ডিসি আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘ইজারা নিয়ে যে পাকা দালান বানিয়েছে তারা, তা আমাদের জানা ছিল না। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমার নজরে আনলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করি। এই ইয়ার্ডের ইজারা বাতিল করা হয়।’ বনভূমি কীভাবে ইজারা দেওয়া হলো, এমন প্রশ্নে ডিসি বলেন, ইজারা দেওয়া হয়েছিল তিনি আসার আগে।
চার থেকে পাঁচ হাজার গাছ ধ্বংস
গত ৩০ মে সরেজমিন দেখা যায়, ইয়ার্ডের জন্য দুটি ভবন তৈরি করা হয়েছে। আশপাশে আনুষঙ্গিক কাজকর্ম চলছে। উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসন যদি তাদের আপত্তি আমলে নিত, তাহলে এই সবুজবেষ্টনী রক্ষা পেত। প্রথম ইজারা পাওয়ার পরই তারা গাছ কেটে সেখানে সমতল করে ফেলে। গাছের গুঁড়ি পর্যন্ত তুলে ফেলে। এরপর স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করে।
জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবদুর রহমান বলেন, ‘প্রথম ইজারা থেকে বাধা দিয়ে আসছি। দ্বিতীয়টি জানতে পারি ইজারা দেওয়ার পর। এরপর বারবার চিঠি লিখেছি জেলা প্রশাসনকে, কিন্তু জবাব পাইনি। ইজারা দেওয়ার পর থেকে গাছ কাটা শুরু হয়। এ ব্যাপারে চারটি মামলা করেছিলাম।’
বন বিভাগের সূত্র মতে, ’৮০ ও ’৯০ দশকে এসব গাছ লাগানো হয়। পাহাড়ি এলাকায় প্রতি দুই মিটার দূরত্বে গাছ লাগানো হয়। উপকূলীয় বনের ক্ষেত্রে আরও কম দূরত্বে গাছ লাগানো হয়। সে হিসাবে ইজারা দেওয়া জায়গায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল। পরে তা পাঁচ থেকে ছয় হাজারে এসে ঠেকেছে।
উপকূলীয় বন বিভাগ সদরের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. রাশেদুজ্জামানের মতে, ইয়ার্ডের ইজারার পর চার থেকে পাঁচ হাজার গাছ ধ্বংস করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইয়ার্ডমালিক আবুল কাসেমকে আজ বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
‘দায় অবশ্যই প্রশাসনকে নিতে হবে’
পরিবেশবিদেরা বলছেন, ইজারা বাতিল হওয়ার পর বন বিভাগের এত দিনের দাবি আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময়ে প্রশাসনের উদারতায় এত বিপুলসংখ্যক গাছ লোপাটের দায় কে নেবে, এ প্রশ্ন তাঁদের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে এই পাঁচ একর বনভূমি ধ্বংস হওয়ার দায় নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর ভূমি প্রশাসন একই জায়গা একই দাগের একই বনভূমি প্রথম যাঁর বিপক্ষে রায় এল তাঁর স্ত্রীকে দিল। এটা আইনের শাসনের প্রতি একটা মারাত্মক বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন।’ বনের পাশাপাশি আইনের শাসনের যে সাংঘাতিক ক্ষতিটা হয়ে গেল, সেটার দায় অবশ্যই প্রশাসনকে নিতে হবে।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, যে ডিসি এই ইজারা দিয়েছিলেন জনপ্রশাসনে তিনি থাকেন কীভাবে, দেশে যদি ন্যূনতম আইনের শাসনও থেকে থাকে, সেটাই হচ্ছে এখন দেখার বিষয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় কর্মরত ডিসি মো. মমিনুর রহমান আজ মুঠোফোনে বলেন, ‘কোন ইয়ার্ড? এত কাজের ভিড়ে মনে নেই। তবে যদি শর্ত ভঙ্গ করে তাহলে বিধিমোতাবেক যে ব্যবস্থা, তা নেবে প্রশাসন।’ বেলার আদালত অবমাননার আবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়।
চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি মমিনুরের হয়ে ইজারার চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহদাত হোসেন। তিনি বলেন, ইজারার শর্ত ভঙ্গ করার কারণে এবং গাছপালা কাটার অভিযোগে সেখানে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়।