বরিশালে মেয়র পদে সাতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আলোচনায় আছেন চারজন।
বরিশাল সিটি নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, ভোটের সমীকরণ নিয়ে ততই চলছে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। দলগতভাবে বিএনপি ভোট বর্জন করায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নজর এখন দলটির ভোটব্যাংকের দিকে। পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, বিএনপির ভোটব্যাংক যাঁর দিকে ঝুঁকবে, তিনিই হয়ে উঠবেন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
এবার মেয়র পদে সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আলোচনায় আছেন চারজন। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি ফয়জুল করিম, জাতীয় পার্টির (জাপা) ইকবাল হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাত্রদলের সাবেক নেতা কামরুল আহসান ওরফে রূপণ। বিএনপি ভোটে না থাকায় দলের ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে নজর দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য তিন প্রার্থী।
ইসলামী আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বিএনপি ভোটের মাঠে নেই। দলটির সমর্থকেরা ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিমকেই বেছে নেবেন। দলের মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব জাকারিয়া হামিদী বলেন, বরিশালের উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুফতি ফয়জুল করিমের প্রতি মানুষ আস্থাশীল। বিএনপির ভোটাররা এ ভাবনা থেকেই ইসলামী আন্দোলনকে ভোট দেবেন।
মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কারী মহসিন উল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপির গঠনতন্ত্র আর আমাদের গঠনতন্ত্র এক ও অভিন্ন। এখানে বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই।
জাতীয় পার্টিই হবে তাঁদের প্রধান পছন্দ। আমরা ইসিকে পরীক্ষা করতে নির্বাচনে গিয়েছি। এটা ইসির জন্য অ্যাসিড টেস্ট।’ তাঁর দাবি, ইসলামী আন্দোলন সরকারের বিশ্বস্ত সহযোগী দল। তাই বিএনপি কখনোই তাদের ভোট দেবে না।
স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বলছেন, ‘সুষ্ঠু ভোট হলে ফলাফলেই এর প্রতিফলন দেখতে পাবেন। আগাম কিছু বলতে চাই না।’
তবে ভোটের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কামরুলই আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকেরা। পাশাপাশি কামরুলের ওপর চাপও বাড়ছে।
কামরুলের বাবা প্রয়াত আহসান হাবিব বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মেয়র শওকত হোসেনকে (হিরণ) পরাজিত করেছিলেন। আহসান হাবিব মহানগর বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবীবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই কামরুল নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। কিন্তু শুরুতে এতে তেমন সাড়া ছিল না।
বিএনপির মহানগরের নেতারাও ‘দলের কেউ নন’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে খুব একটা গায়ে মাখেননি। কিন্তু প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর ভোটের সমীকরণে ঘুরেফিরে কামরুলের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় বিএনপির কারণ দর্শানোর নোটিশে। যেখানে কামরুলসহ বিএনপির সাবেক ও বর্তমান ১৯ জন নেতাকে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার কারণ জানতে চাওয়া হয়। পরে তাঁদের বহিষ্কারও করা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি কামরুলের তিন কর্মীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
মহানগর বিএনপির সাবেক ও বর্তমান অন্তত ছয়জন নেতা বলেন, মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটির শীর্ষ কয়েকজন নেতা কামরুলকে সমর্থন না করলেও দলের একটি বড় অংশ তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল। বরিশালে তাঁদের শক্তিশালী অবস্থান আছে। পাশাপাশি জামায়াতের ভোটারদের সহানুভূতিও কামরুলের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বরিশালে প্রচার-প্রচারণায় ইসলামী আন্দোলন শুরু থেকেই সাড়া ফেলেছে। জাপার প্রার্থীও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। সেই অনুযায়ী কামরুলকে প্রচার-প্রচারণায় বেশ কৌশলী বলে মনে করছেন ভোটাররা। ভোটও চাইছেন অনেকটা নীরবে-নিভৃতে।
বিএনপির নেতারা জানান, বরিশালে বিএনপির ভোটার-সমর্থকেরা কেন্দ্রে গেলে সিংহভাগ ভোট কামরুলের পক্ষে পড়বে। নেতাদের যুক্তি, বরিশালে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপিপন্থী ২০ জন কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া জামায়াতেরও চারজন প্রার্থী আছেন।
এসব প্রার্থী নিজেদের জয় নিশ্চিতে সমর্থক ভোটারদের কেন্দ্রে হাজির করবেন। তাঁদের ভোট দিতে মেয়র পদেও ভোট দেবেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে তাঁদের অধিকাংশ ভোট কামরুলের পক্ষে যেতে পারে। এ ছাড়া বাবার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, জনপ্রতিনিধি থাকায় বাবার সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভোট কামরুল পেতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে কামরুলই হয়ে উঠতে পারেন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
মহানগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক বলেন, ভোটের সমীকরণে কামরুল ফেলে দেওয়ার মতো প্রার্থী নন। বিএনপির সমর্থকেরা হাতপাখা বা লাঙ্গলে ভোট দেবেন এটা অবিশ্বাস্য। কেন্দ্রে গেলে তাঁদের প্রথম ও একমাত্র পছন্দ হবেন কামরুল।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, ‘কামরুল আশ্চর্যজনক কিছু করে ফেলতে পারেন, এখন এমনটাই মনে হচ্ছে। বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোটারদের কেন্দ্রে আনার ওপর এটি নির্ভর করছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী খায়ের আবদুল্লাহ বরিশালে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কে আসবেন, সেটাই বড় সমীকরণ।’
গত শুক্রবার দিবাগত রাতে মো. রমজান, মোনায়েম খান ও সৈয়দ রফিকুল ইসলাম নামে কামরুলের তিন সমর্থককে বাসা থেকে থানায় ডেকে নিয়ে একটি পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের মধ্যে রমজান যুবদলের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের আহ্বায়ক। মোনায়েম ও রফিকুল বিএনপির কর্মী।
কামরুল আহসান অভিযোগ করেন, প্রার্থী হওয়ার পর থেকেই তাঁকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রথমে দুদক তাঁকে তলব করে এক ঘণ্টার বেশি সময় জিজ্ঞাসাবাদ করে। নিয়ম না থাকলেও বাবা-দাদার সম্পদের হিসাব চেয়েছে। এরপরও তাঁকে দমাতে না পেরে কর্মীদের পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করছে। কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাতে এসব করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন বলেন, ওই তিনজন বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত ব্যানার ছেঁড়ার ঘটনায় করা পুরোনো একটি মামলার আসামি। এ জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর সঙ্গে নির্বাচনের কোনো যোগসূত্র নেই। নির্বাচনের আগে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা পুলিশের নিয়মিত অভিযানের অংশ।