পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন আগুনে পুড়ে ছাই

0
98

জরাজীর্ণ টিনের ঘরের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছিল খোদেজা বেগমের (২৩) আহাজারি। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে চোখ মুছছিলেন অন্যরা। খোদেজার স্বামী মো. রাসেল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া ইউনিয়নের মতইন গ্রামের বাসিন্দা।

গত সোমবার রাত তিনটায় (স্থানীয় সময়) সংযুক্ত আরব আমিরাতে শারজার একটি আসবাবের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় মারা যান কারখানার ভেতরে থাকা রাসেলসহ তিনজন। বাকি দুজন হলেন পলতি তারাবাড়িয়া গ্রামের মো. ইউসুফ (৪৩) ও তারেক হোসেন (৪০)। গতকাল মঙ্গলবারই আরব আমিরাতে বসবাসকারী স্বজনদের মাধ্যমে তাঁরা দুর্ঘটনার খবর জানতে পারেন।

আজ বুধবার সকালে মতইন গ্রামে নিহত রাসেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কারও সান্ত্বনাই যেন রাসেলের স্ত্রী খোদেজা বেগমকে শান্ত করতে পারছে না। খোদেজার কোলে ১৮ মাস বয়সী মেয়ে সামিয়াও মাকে দেখে কেঁদে চলছে। অন্যরা কোলে নিতে চাইলেও যাচ্ছে না।

রাসেলের চাচা ফাজিল মিয়া বলেন, প্রায় দেড় বছর আগে তাঁর ভাতিজা ধারদেনা করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাড়ি জমান। যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তেমন টাকাপয়সাও পাঠাতে পারেননি বাড়িতে। পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা আবদুল ওহাব মারা গেছেন সাত-আট বছর আগে। এখন পরিবারটি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।

একই চিত্র চোখে পড়ে আরেক প্রবাসী তারেক হোসেনের বাড়িতে। তারেকের মা পেয়ারা বেগম ঘরের সামনের চেয়ারে বসে কাঁদছিলেন। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আঁর মনা কইরে, আন্নেরা আঁর মনারে আনি দেন। আঁই আর কিচ্ছু চাই ন, আঁর মনার হোড়া (পুড়ে যাওয়া) যাইন্না লাশগা অইলেও (হলেও) শেষ দেখা দেইখতে চাই।’

ঘরের সামনে বসা তারেকের বাবা মীর আহম্মেদ ছেলের শোকে পাগলপ্রায়। তিনি বলেন, তাঁর চার ছেলে। তাঁদের মধ্যে দুই ছেলেই প্রতিবন্ধী। এই ছেলেটিই ছিল তাঁর সংসারের বাতি এবং একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁর আয়েই চলত গোটা সংসার। এখন ছেলের দুই সন্তান, স্ত্রীসহ বাকি সবাই কীভাবে চলবেন? কীভাবে ছেলের লাশ দেশে আনবেন, কার কাছে যাবেন—কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।

অগ্নিকাণ্ডে নিহত তারেক হোসেন (বাঁয়ে), মো. রাসেল (মাঝে) এবং মো. ইউসুফ
অগ্নিকাণ্ডে নিহত তারেক হোসেন (বাঁয়ে), মো. রাসেল (মাঝে) এবং মো. ইউসুফছ

একই গ্রামের বাসিন্দা মো. ইউসুফ (৪৩) দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে প্রবাসে জীবন কাটাচ্ছিলেন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ওই আসবাবের কারখানাটি করেছিলেন। সেই কারখানাতেই পুড়ে মারা গেলেন তিনি। আজ সকালে পলতি তারাবাড়িয়া গ্রামে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনেরা শোকে মুহ্যমান। বসতঘরের ফটকে বসেছিলেন ছোট ভাই গোলাম রসুল, দুই ছেলে মাঈনুল ইসলাম (২০) ও মেহেদী হাসান (১৬)।

গোলাম রসুল বলেন, পাঁচ বছর আগে তাঁর ভাই সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন। আগে তিনি আরব আমিরাতে একটি আসবাবের কারখানায় চাকরি করতেন। বছরখানেক আগে নিজেই একটি কারখানা দিয়েছেন। সেই কারখানাতেই সোমবার রাত তিনটার দিকে (স্থানীয় সময়) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। সে দেশে বসবাসকারী আত্মীয়স্বজনেরা লাশ দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে পুলিশ তাঁদের লাশ দেখায়নি। সরকারিভাবে যেন লাশগুলো শনাক্ত করে দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা করা হয়।

ইউসুফের বড় ছেলে মাঈনুল বলেন, পুরো পরিবার চলত তাঁর বাবার আয়ে। কারখানা দেওয়ার ধারদেনাও এখনো শোধ করতে পারেননি। তাঁদের সংসারে অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন কীভাবে সামনের দিনগুলো যাবে, কে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াবে—কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.