দৃশ্যমান কোনোরূপ অনিয়ম ও বাড়াবাড়ি ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৮৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। জায়েদা খাতুন পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। আজমত উল্লা পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৪৭ ভোট।
আজমত উল্লা একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ। তিনি তিনবার টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলেন। তিনি একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। সজ্জন হিসেবেও তাঁর সুনাম আছে। পক্ষান্তরে জায়েদা খাতুন একজন স্বশিক্ষিত, অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
তাঁর মুখ্য পরিচয়, তিনি সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা। চারদিকে প্রশ্ন উঠছে, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে কেন এমন অস্বাভাবিক ফলাফল? নির্বাচনটি কেনই-বা শান্তিপূর্ণ হলো? গাজীপুর থেকে পরবর্তী চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে কী বার্তা পাওয়া গেল?
জায়েদা খাতুনের জয়ের পেছনে অনেক বিষয় কাজ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। প্রথমত, ক্ষমতাসীন দল তাঁকে সম্ভবত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড বিবেচনায় নিলে এমন ধারণা জন্মানো অসম্ভব নয়। কারণ, শিক্ষা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে দুজনের মধ্যে ব্যাপক অসমতা রয়েছে। সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম প্রার্থী হলে অবশ্য ভিন্ন কথা ছিল।
দ্বিতীয়ত, জায়েদা খাতুনের প্রতি সম্ভবত ভোটারদের একধরনের সহানুভূতি কাজ করেছে। অনেকের ধারণা ছিল, অন্যায়ভাবে জাহাঙ্গীর আলমের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। ফলে তাঁরা এর প্রতিশোধ হিসেবে তাঁর মাকে জেতাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। অন্য দলের সমর্থক, এমনকি বিএনপির সমর্থকদের অনেকেই সরকারি দলকে বিব্রত করার লক্ষ্যে জায়েদা খাতুনকে ভোট দিয়েছেন, এমন সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া টাকার খেলা, যা অদৃশ্যভাবে ঘটে, তার একটি জোর গুজবও বাজারে রয়েছে।
তৃতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা এবং দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নসহ নানা অপকর্মের কারণে সরকারি দলের সমর্থন কমে যাওয়া স্বাভাবিক। সরকারি দলের কিছু কিছু নেতার বাগাড়ম্বর ও অযৌক্তিক কথাবার্তাও অনেক নাগরিককে ক্ষুব্ধ করে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিও সাধারণ নাগরিককে সরকারি দলের প্রার্থী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করেছে বলে অনেকের বিশ্বাস।
আমি নির্বাচনের আগেই বলেছিলাম যে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হবে। নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, নির্বাচনী মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতি। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০১৮ সালের গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি ছিল ‘নিয়ন্ত্রিত,’ যেখানে নির্বাচন কমিশনের যোগসাজশে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিরোধী দলকে বহুলাংশে মাঠছাড়া করতে সক্ষম হয়েছিল। এবার বিরোধী দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার কারণে গাজীপুরের সিটি নির্বাচনে সে ধরনের হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গিয়েছিল। সরকারি দলেরও এখানে বাড়াবাড়ি করতে হয়নি।
শান্তিপূর্ণভাবে গাজীপুর সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো, নির্বাচনের আগের রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা। নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হলে (যেগুলো আমাদের আইন অনুযায়ীই নির্বাচনী অপরাধ) যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা থেকে নিজে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যের বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের নির্বাচনী অপরাধে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রেখেছে বলে অনেকের বিশ্বাস।
তবে গাজীপুর সিটি নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও তা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল না। ফলে গাজীপুরের নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে হলে ভোটারদের সামনে বিকল্প—বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প—থাকতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন তৃষ্ণার্তকে এক গ্লাস মিনারেল ওয়াটার আর এক গ্লাস ট্যাপের পানির মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায় যে তিনি ট্যাপের পানি বেছে নেবেন না। একই ব্যক্তিকে এক গ্লাস ফোটানো পানি ও এক গ্লাস ট্যাপের পানির মধ্য থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে আবারও তিনি ট্যাপের পানি নিতে রাজি হবেন না। ওই ব্যক্তিকে মিনারেল ওয়াটার ও ফোটানো পানি থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দিলে তিনি ফোটানো পানিও বেছে নিতে পারেন, আবার মিনারেল ওয়াটারও বেছে নিতে পারেন। কারণ, দুটিই এক অপরের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প।
তাই বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প থাকলেই তাদের মধ্য থেকে ‘ভোটারদের’ বেছে নেওয়ার বা ‘ইলেক্ট’ করার সুযোগ থাকে। আর তা না থাকলে ভোটারের ‘নির্বাচন’ করারই সুযোগ থাকে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্য প্রার্থী না থাকার কারণে গাজীপুরের সিটি নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও তাকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য বলা যায় না।
গাজীপুরের সিটি নির্বাচন বাকি চারটি সিটি নির্বাচন ও পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের জন্য কী বার্তা বহন করে? ওই সব নির্বাচনও কি শান্তিপূর্ণ হবে? বরিশাল ছাড়া বাকি তিনটি সিটি নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হতে পারে। কারণ, সেগুলোয় প্রধান বিরোধী দল মনোনীত কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী নেই। তাই সেগুলোয় জেতার জন্য ক্ষমতাসীনদের এবং তাদের অনুগত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদেরও বাড়াবাড়ি করতে হবে না। তবে বরিশালে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে গুরুতর বিভক্তি এবং সেখানে ইসলামী আন্দোলনের শক্ত প্রার্থী থাকার কারণে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ না-ও হতে পারে।
জাতীয় নির্বাচনে অবশ্য ভিন্ন হিসাব। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল হবে এবং এর সঙ্গে অনেক স্বার্থ, এমনকি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের প্রশ্নও জড়িত। তাই সে নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রধান দলগুলো মরিয়া হয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করাই স্বাভাবিক। তাই সেই নির্বাচন কতটা শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হবে, সেই প্রশ্নটি জরুরি। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সাংবিধানিক কাঠামো বর্তমানে কার্যকর রয়েছে, সেটাই এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করার মাধ্যমে নির্বাচনী মাঠকে ক্ষমতাসীনদের—পক্ষে এবং বিরোধী দলের বিপক্ষে—অসম করে ফেলা হয়েছে। কারণ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দলের প্রধান হবেন সরকারপ্রধান এবং সংসদ নেতা এবং তাঁর অধস্তন মন্ত্রিসভার অধীনেই থাকবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ ছাড়া সংসদ তখন বহাল থাকবে, তাই বর্তমান সংসদ সদস্যরা তাঁদের সব ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ফলে বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন হওয়ার আশা করার সুযোগ নেই।
আমাদের অভিজ্ঞতাও তা-ই। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১১টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার সাতটি হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে এবং এর সব কটিই ছিল বিতর্কিত, যাতে ক্ষমতাসীনেরাই ক্ষমতায় টিকে ছিল। পক্ষান্তরে দলীয় সরকারের বাইরে অনুষ্ঠিত অন্য চারটি নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদলও হয়েছিল। কারণ, এর মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমসুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল।