চিপকের চিদাম্বরম স্টেডিয়ামে গুজরাট টাইটানসের বিপক্ষে চেন্নাই সুপার কিংসের প্রথম কোয়ালিফায়ার ম্যাচ। ১৮তম ওভারে শেষ বলে অম্বাতি রাইডু আউট হওয়ার পর মাঠে নামেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এই মাঠে এর আগেও অনেকবার মাঠে নেমেছেন, কিন্তু সেদিন ধোনির মাঠে নামার মুহূর্তটা ছিল একটু অন্য রকম। ধোনি ড্রেসিংরুম থেকে মাঠের দিকে ধীর পায়ে যতই এগিয়ে আসছিলেন, চিদাম্বরমের গ্যালারি ততই গর্জে উঠছিল।
ধোনি মাঠে নামতেই আবার শুরু হয় নতুন দৃশ্যের মঞ্চায়ন। গ্যালারিতে দর্শকেরা মুঠোফোনের বাতি জ্বালিয়ে পুরো চিদাম্বরমকে আলোকিত করে তোলেন। ঘরের মাঠে সম্ভাব্য শেষ ম্যাচে ধোনিকে এভাবেই শ্রদ্ধা জানান চেন্নাইয়ের সমর্থকেরা। ধোনি অবশ্য এবার আইপিএলজুড়েই এমন অভিবাদন পেয়ে এসেছেন। গুজরাটের বিপক্ষে ব্যাটসম্যান ধোনি সমর্থকদের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারেননি, আউট হয়েছেন ১ রান করে। কিন্তু অধিনায়ক ধোনি ঠিকই ছিলেন স্বমহিমায়।
সময় নষ্টের পরিকল্পিত প্রদর্শনী: একটি ধোনি পরিবেশনা
আজ আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে আরও একবার ধোনির নেতৃত্ব-জাদু দেখার অপেক্ষায় থাকবেন চেন্নাই সমর্থকেরা। ধোনির যে জাদু চেন্নাইকে এনে দিতে পারে পঞ্চম আইপিএল-শিরোপা। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের বিদায়-লগ্নে চেন্নাইকে এর চেয়ে সুন্দর আর কী উপহার দিতে পারেন ধোনি! হয়তো এই ম্যাচ দিয়েই নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানতে পারেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’।
এরই মধ্যে নিজের অর্জনের মুকুটে যত পালক যুক্ত করেছেন, আইপিএলের ইতিহাসের সেরা অধিনায়ক তাঁকে বলে দেওয়াই যায়। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার ও কোচ টম মুডি যেমন বলেছেন, ‘আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, টি-টোয়েন্টিতে সেরা অধিনায়ক কে? আমি বলব, এমএস ধোনি। আর সেটা আমরা এ বছর আরও একবার দেখেছি।’
এমন না যে আজ ফাইনালে হেরে গেলে ধোনির সেই মাহাত্ম্য কিছুটা কমে যাবে। কিন্তু ফাইনালে এসে কে আর হারতে চায়! আরেকটি ট্রফি ধোনির ক্যাবিনেটের শ্রী বৃদ্ধিই তো ঘটাবে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, ‘চেরি অন দ্য কেক’। ধোনির অর্জনের কেকের ওপর সেই চেরিটাই হতে পারে আজকের শিরোপাটি।
এই যাত্রাটা অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি। শুধু মাঠের ফল দিয়েও নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় তুলেননি ধোনি। বিদায়-লগ্নে এসে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা মিলবে বন্ধুর এক পথেরও। যেখানে লড়াইটাই ছিল শেষ কথা। প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে ধোনির জীবনে ঘটে যাওয়া সেসব ঘটনার সবটায় আমাদের জানা হয়ে গেছে। নিজের মস্তিষ্কের জাদু ধোনি একবার নয়, বারবার দেখিয়েছেন।
আইপিএলে সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলেছেন ধোনি, এরপর কে
আর একই ঘটনা যখন বারবার ঘটতে থাকে এবং বিভিন্ন মোড়কে সামনে আসতে থাকে, তখন সেটা পরিণত হয় গল্পে। আর সেসব গল্প মানুষের মুখে মুখে ফিরে একদিন রূপ নেয় মিথ বা কল্পকথায়। ধোনিও এখন যেন ক্রিকেটের সেই কল্পকথাগুলোর একটি হতে চলেছেন বা হয়ে গেছেন। পেছনে তাকালে যাঁর অর্জনগুলোকে মনে হবে অবিশ্বাস্য। যখনই মনে হচ্ছিল আর সম্ভব নয়, তখনই উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে অঙ্গুলিহেলনে তিনি যেন দলের ভাগ্য গড়ে দিয়েছেন।
ধোনি নিজের ভবিষ্যৎ ঠিক করবেন ডিসেম্বরে
অধিনায়ক ধোনির আইপিএল ক্যারিয়ারের দিকেই একবার তাকানো যাক। বিরাট কোহলি যে ট্রফির জন্য মাথাখুটে মরছেন, ধোনি সেই একই টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলাকে ডালভাত বানিয়ে ফেলেছেন। চেন্নাইয়ের হয়ে ১৬ আসরের মধ্যে ১৪টিতে অংশ নিয়ে এটি ধোনির দশম ফাইনাল। চেন্নাই নিষিদ্ধ থাকায় দুই আসরে ধোনি খেলেছেন রাইজিং পুনে সুপার জায়ান্টের হয়ে। সেখানেও একবার ফাইনালে খেলেছেন ধোনি। যদিও সে আসরে তিনি অধিনায়ক ছিলেন না। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ১৬ আসরে ১১টিতেই ফাইনালের কোনো একটি দলে আছে ধোনির নাম, যার ১০টিতেই তিনি আবার অধিনায়ক।
শুধু কি এটুকুই, আইপিএলে এর মাঝে কত অধিনায়ক এলেন-গেলেন, থেকে গেলেন শুধু ধোনিই। যাঁদের সঙ্গে ধোনি দাঁড়িয়ে টস করেছেন, তাঁদের অনেকে এখন ডাগআউটে কোচিং করাচ্ছেন বা ধারাভাষ্য কক্ষ সামলাচ্ছেন। নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে রয়ে গেলেন শুধু ধোনিই। যে হার্দিক পান্ডিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ধোনি আজ ফাইনালে টস করবেন, তাঁর কথায় ধরা যাক। আইপিএলের অভিষেক মৌসুমে ধোনি যখন চেন্নাই অধিনায়ক হিসেবে ফাইনালে টস করেন, তখন পান্ডিয়ার বয়সই ছিল মাত্র ১৫ বছর।
অধিনায়ক ধোনি শুধু মাঠেই নন, মাঠের বাইরেও দলীয় বন্ধনের দারুণ এক সংস্কৃতি তৈরি করেছেন। যে বিরাট কোহলির হাতে ধোনি জাতীয় দলের নেতৃত্ব ছেড়েছিলেন, সেই কোহলি যখন ছন্দ হারিয়ে লড়ছিলেন, তখন সবার আগে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ধোনিই। কিছু দিন আগে নিজের দুঃসময়ে ধোনিকে কীভাবে পাশে পেয়েছিলেন তা জানাতে গিয়ে কোহলি বলেছিল, ‘আমার পরিবার এবং শৈশবের কোচকে বাদ দিলে যে মানুষটি সত্যিকার অর্থে আমার পাশে ছিলেন, তিনি হলেন এমএস ধোনি।’
শুধু কোহলিই নন, এখনো ধোনির জন্য রবীচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজা কিংবা সুরেশ রায়নারা নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিতে প্রস্তুত। ধোনি নিজের প্রভাব জাতীয় দলের হয়ে যেভাবে তৈরি করেছিলেন, তেমনটা করেছেন চেন্নাইয়েও। রায়না যেমনটা বলছিলেন, ‘আমি প্রথমত ধোনির জন্য খেলতাম। এরপর দেশের জন্য।’
শেষটা কি সুন্দর হবে শুবমান গিলের
একজন মানুষের প্রভাব এমন আকাশ-সঞ্চারী না হলে কাউকে এভাবে বিমোহিত করে রাখতে পারেন না। আর সে কারণেই তিনি ধোনি! অধিনায়ক হিসেবে সতীর্থদের ওপর ধোনির এই প্রভাবকে কেউ চাইলে ‘ধোনিবাদ’ও বলতে পারে। তাই ধোনি হয়তো আজ খেলেই বিদায় নেবেন, কিন্তু ধোনিবাদের প্রভাব আরও অনেক বছর ধরে ভারত ও চেন্নাইয়ের ক্রিকেটে থেকে যাবে।