ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের ‘ডামি প্রার্থী’ থেকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র বনে গেছেন জায়েদা খাতুন। সাবেক মেয়র এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীরের ছায়ার বিরুদ্ধে সুষ্ঠু নির্বাচনে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত দেড়টায় ঘোষিত বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী, ৪৮০ ভোটকেন্দ্রে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়েছেন। নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। জায়েদা খাতুন ১৬ হাজার ১৯৭ ভোট বেশি পেয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের গাজী আতাউর রহমান ৪৫ হাজার ৩৫৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। ভোট দিয়েছেন ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোটার। রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম এই ফল ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করে ২০২১ সালে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন জাহাঙ্গীর। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার হন। চলতি বছরেই সাধারণ ক্ষমায় দলে ফেরেন। কিন্তু মেয়র পদে নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আবার আজীবনের জন্য বহিষ্কার হন আওয়ামী লীগ থেকে। কিন্তু ঋণখেলাপির কারণে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোট করতে পারবেন না আশঙ্কায় মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর।
পুরো নির্বাচনী প্রচারে ছেলের ছায়া হয়েছিলেন জায়েদা। মা কাগজকলমে প্রার্থী হলেও বাস্তবে ভোটে লড়েছেন ছেলে। ফলে তাঁর জয় আদতে জাহাঙ্গীরের বিজয়। ক্ষমতাসীন দলের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েও আজমত উল্লার মতো শক্তিশালী প্রার্থী গৃহিণী জায়েদার বিরুদ্ধে হেরে যাবেন, তা কেউ ধারণাই করতে পারেননি। কিন্তু সুষ্ঠু ভোটে সব হিসাব পাল্টে গেছে।
গতকাল ভোট চলাকালে দিনভর অধিকাংশ কেন্দ্রে জায়েদা খাতুনের এজেন্টদের ছিল না। কিন্তু নির্লিপ্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর। সন্ধ্যার পর নগরের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ভোটের ফল আসতে শুরু করে তখন ছিলেন শান্ত। সবাইকে চমকে দিয়ে শুরু হয় টেবিল ঘড়ির জয়ধ্বনি। ভোট গণনা কেন্দ্রে একবারের জন্যেও আসেননি আজমত উল্লা। তাই সন্ধ্যা থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, ফল তাঁর প্রতিকূলে যাচ্ছে।
ফল ঘোষণার সময় আসেননি জায়েদা খাতুনও। জাহাঙ্গীরকে ঘিরেই মধ্যরাতে বিজয় উল্লাসে মাতেন সমর্থকরা। তখনও দেখা মেলেনি জায়েদার। ফলে জায়েদা মেয়র নির্বাচিত হলেও গাজীপুরের চাবি থাকছে জাহাঙ্গীরের হাতেই। বিজয়ের পর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার মা সবাইকে নিয়ে গাজীপুরের উন্নয়ন করবেন।
এর আগে দিনভর ভোটারের ঢল, শৃঙ্খলা, কৌশল সবই ছিল গাজীপুরের নির্বাচনে। যদিও দেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনে অনেকেরই ধারণা ছিল ভোট হবে একতরফা। তবে কিন্তু সব ধারনা ভুল করে কেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। ভোটকেন্দ্রে ছিল সিসি ক্যামেরা। গোপন বুথে ‘ডাকাত’ দেখা যায়নি। বহিরাগতরা বুথে ঢুকে ভোটারের ভোট দিয়ে দেয় বলে যে গুরুতর অভিযোগ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে পাওয়া যাচ্ছিল, তা গাজীপুরে ওঠেনি। ভোটাররা নিজের ভোট নিজেই দিতে পেরেছেন।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বিশ্লেষকরা বলে আসছেন, অনিয়ম ও কারচুপির নিয়মিত অভিযোগের কারণে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকেও সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর নানামুখী চাপের গুঞ্জনও ছিল। ভোটের আগের রাতে মার্কিন ভিসা নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা আসে। সুষ্ঠু ভোটে বাধা দানকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পড়বেন। এ ঘোষণা গাজীপুরের ভোটে নতুন মাত্র যোগ করে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত মাস আগে, গাজীপুরের নির্বাচন গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বাধ্য হয় সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসিও বলেছিল, গাজীপুরের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ দেশের মানুষ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তাকিয়ে আছে এ নির্বাচনের দিকে। গাজীপুরের সুষ্ঠু ভোট কিছুটা হলেও চাপমুক্ত করছে ইসিকে। রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনী অনিয়মের আরেকটি অভিযোগ থেকেও রেহাই পাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও।
ভোট শেষে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে কমিশন সদস্যরা বলেছেন, গাজীপুরে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে। এর আগে কমিশন সদস্যরা ইসির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে বসে বড় স্ক্রিনে ভোট পর্যবেক্ষণ করেন এবং ভোটের মাঠে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠান।
গতকালের ভোটে ৪৮০ কেন্দ্রের মধ্যে তেমন কোথাও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চোখে পড়েনি। তবে নারী ভোটারদের মধ্যে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের অনভ্যস্থতায় ভোট গ্রহণে ধীরগতি ছিল। ভোট গ্রহণ শেষে ঢাকা নির্বাচন কমিশন ভবনে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর জানিয়েছেন, এমন ভোটে কমিশন সন্তুষ্ট। কারণ সারাদিন কেউ কোনো অন্যায় করেনি। এটাই কমিশনের সবচেয়ে বড় সফলতা।
সাধারণ ভোটাররা বলছেন, ভোটকেন্দ্রে বা বাইরের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত চমৎকার। এই নির্বাচনে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও ইসির নিবন্ধিত আরও চারটি দলের প্রার্থী এবং তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ আটজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে নির্বাচনী মাঠে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর তৎপরতা ছিল না। অধিকাংশ কেন্দ্রে নৌকা ও গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলামের মাছ ছাড়া অন্য প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্টও ছিল না।
তবে সন্ধ্যায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল আসতে শুরু করলে সবার চোখ কপাল উঠতে শুরু করে। রাত ১২টা পর্যন্ত হাড্ডহাড্ডি লড়াই চলে নৌকা ও ঘড়ির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়ায়, আজমত উল্লা জয়ী হয়েছেন। তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেন অনেকে। কিন্তু জাহাঙ্গীর ছিলেন ধীরস্থির, ফল ঘোষণার কেন্দ্র ছাড়েননি। হাতে লেখা ফল ঘোষণার প্রতিবাদ করেন। এক পর্যায়ে ফল ঘোষণা বন্ধ ছিল। এতে উত্তেজনা ছড়ায়। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফল ঘোষণা না করে শুধু মেয়র প্রার্থীদের ভোটার সংখ্যা ঘোষণা করেন।
২০১৮ সালে তিনি ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সরকার ও প্রশাসনের বিশেষ আনুকূল্যে নির্বাচনী প্রচার কাজ চালিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। এমনকি ওই সময় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সহায়তায় ভোট কারচুপির অভিযোগও তুলেছিলেন। এবার সেই জাহাঙ্গীরকেই পুরো উল্টো স্রোতে চলতে হয়েছে। তিনি নিজেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন এবার। কেন্দ্রে তাঁর নির্বাচনী এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়া বা বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন দিনভর। তাঁর সঙ্গে এবার দল ছিল না, প্রশাসনও ছিল না। দিনভর মায়ের হাত ধরে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঘোরেন।
গতকালের ভোটে ভোটারদের সরব উপস্থিতির ব্যাপারে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাধারণ ভোটাররাও আশা করেননি এত ভালো পরিবেশে ভোট হবে। নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়া যাচ্ছে খবরে বাড়তে থাকে ভোটার উপস্থিতি। কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন পড়ে। বিশেষ করে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনে অনিয়ম ঢুকে পড়েছিল। তাই কেন্দ্রগুলো ভোটারশূন্য হতে থাকে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ২৫ দশমিক ৩ এবং দক্ষিণ সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৩০ শতাংশ। ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ভোটার যায়নি কেন্দ্রে। বর্তমান সিইসি হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২২ সালের ১৫ জুন কুমিল্লা সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৫৯ শতাংশ। এই ভোটেও বিএনপির স্থানীয় নেতা সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু অংশ নেন। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রংপুর সিটিতে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল ৬৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
ওই দুই নির্বাচনে সব প্রার্থী প্রায় নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারলেও, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তির বিপরীতে সমর্থকদের মাঠে নামাতে পারেননি জাহাঙ্গীর আলম। তবু ভোটারদের সরব উপস্থিতি অবাক করে দিয়েছে সবাইকে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ করার কথা থাকলেও অনেক কেন্দ্রে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোট চলে।
ভোটে প্রভাব খাটানোর বড় কোনো অভিযোগ পাওয়া না গেলেও নির্বাচন ভবন থেকে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করে ভোটের গোপনকক্ষে অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে দু’জনকে তিন দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্বাচনে একজন নতুন মেয়রের পাশাপাশি ৫৭ জন কাউন্সিলর এবং ১৯ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।