বাংলাদেশে সুপেয় পানি পাওয়ার সুযোগ আছে বেশির ভাগ মানুষের। হাত ধোয়ার অভ্যাসও মানুষের মধ্যে আগের চেয়ে বেড়েছে। তারপরও দেশে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে, পানিবাহিত রোগ বেড়ে যাচ্ছে। উৎসে পানি অপেক্ষাকৃত ভালো থাকলেও এটি পরিবহন ও সংরক্ষণের কারণে রোগবালাই বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (২০২১) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ খাবার পানি পায় টিউবওয়েল বা ট্যাপ থেকে। উন্নত পানি পাওয়ার সুযোগ আছে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের। উৎসে ভালো থাকলেও ব্যবহারের সময় ত্রুটির কারণে পানি দূষিত হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
গ্রামাঞ্চলে পানি এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার চল বেশি। তবে শহরে পরিবহনের বিষয়টি তেমন নেই। এখানে অধিকাংশ মানুষ ট্যাপের সরবরাহের পানি ব্যবহার করে বলে তাদের উৎস ঘরের কাছেই থাকে। গ্রামাঞ্চলে পরিবহনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। গ্রাম ও শহর—সবখানে সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে পানিদূষণের ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তৈরি বহুনির্দেশক গুচ্ছ জরিপে (২০১৯) পানির সংগ্রহ ও ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পানি সংগ্রহের সময় তাতে উচ্চ ঝুঁকির জীবাণুর পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। কিন্তু পানি ব্যবহারের সময় উচ্চ ঝুঁকির জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ শতাংশে।
পানি উৎসে ভালো থাকলেও নানা কারণে এটি দূষিত হতে পারে। এর মধ্যে পরিবহন একটি বিষয়। যেমন ঢাকা ওয়াসার উৎসে পানি ভালো থাকলেও সরবরাহ লাইনের সমস্যার কারণে তা দূষিত হয়ে যায়। গৃহস্থালিতে পানি আনা ও রাখার পাত্রের কারণে তা দূষিত হতে পারে। আবার হাত পরিষ্কার না করেই তা পানিতে ডুবিয়ে দিলে পানি দূষিত হতে পারে। অনেক সময় অপরিষ্কার গ্লাস দিয়ে পানি তোলা হয়। এভাবে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দূষণ ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান খায়রুল ইসলাম বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পানির গুণগত মান অনেক সময় রক্ষিত হচ্ছে না। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির দিকে জোর দিতে হবে। আর এর মাধ্যমেই পানিবাহিত রোগবালাই রোধ সম্ভব হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ইউনিসেফের তৈরি ‘জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম–জেএমপি প্রতিবেদন ২০২১’–এ দেখা যায়, নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও পাইপের মাধ্যমে সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিকে বেশি নিরাপদ এবং শহরের নাগরিক সুবিধার অংশ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি পায়, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশের গ্রামের মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ সরবরাহের পানি পায়। শহরে এটি ৩৬ শতাংশ।
খায়রুল ইসলাম বলেন, সরবরাহের পানি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বলে চিহ্নিত হয়। এর প্রসার বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে হাত ধোয়ার মৌলিক সুযোগগুলো বেড়েছে। জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ, ২০২১–এ দেখা গেছে, হাত ধোয়ার স্থানে পানি ও সাবানের ব্যবস্থা আছে—এমন পরিবারের সংখ্যা এখন ৫৭ শতাংশ। তবে আগের জরিপে (২০১৭-১৮) এ হার ছিল ৩৯।
বাড়ছে পানিবাহিত রোগ
দেশে, বিশেষ করে শিশুদের, পানিবাহিত রোগ বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (২০২১) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর যে ১০ কারণ রয়েছে, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো জন্ডিস। মোট মৃত্যুর ৮ শতাংশের বেশি হয় জন্ডিসের কারণে। এ বয়সী শিশুদের মৃত্যুর পঞ্চম কারণ জটিল ডায়রিয়া। মোট মৃত্যুর ৬ দশমিক ৫০ শতাংশই ঘটে এতে আক্রান্ত হয়ে।
জন্ডিস বা হেপাটাইটিস এবং ডায়রিয়া মূলত পানিবাহিত রোগ। দেখা যাচ্ছে, এ দুই কারণে শিশুমৃত্যু বেড়ে গেছে। পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (২০১৬) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ ছিল জন্ডিস। এতে মোট শিশুমৃত্যুর ২ দশমিক ২ শতাংশ ঘটত। এ সময় জটিল ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যেত প্রায় ৫ শতাংশ শিশু।
দেখা যাচ্ছে, পানিবাহিত দুটি রোগে পাঁচ বছরের ব্যবধানে শিশুমৃত্যু বেড়ে কয়েক গুণ হয়েছে।
দেশের বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, পানিবাহিত রোগগুলোর মধ্যে ডায়রিরা, জন্ডিস, রক্ত আমাশয় এবং টাইফয়েডে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া, জন্ডিস ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। শুধু পানি নয়, নানা ধরনের অস্বাস্থ্যকর খাবারও এসব রোগের কারণ।
অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা জানান, শিশুদের মধ্যে যাদের জন্ডিস আছে, তাদের ৮০ শতাংশই হেপাটাইটিস এ–তে আক্রান্ত। এ ছাড়া হেপাটাইটিস ই–তেও আক্রান্ত অনেক শিশু। এ দুটিই পানিবাহিত রোগ বলে জানান তিনি।
গরমকালে মানুষ যত্রতত্র পানি খায়। তাই এ সময় জন্ডিস ও টাইফয়েডের প্রবণতা বাড়ে বলে জানান তিনি।
দেশে সুপেয় পানি পাওয়ার হার বাড়লেও পানিবাহিত রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী—এ প্রশ্নের জবাবে আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, উৎসের পাশাপাশি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিধি মেনে চলা হয় বলে মনে হয় না। পানির উৎস থেকে ব্যবহার—সবখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উচিত।