ভোলার বিভিন্ন উপজেলার জলাশয়ে ১০ বছর আগেও কচ্ছপ পাওয়া যেত। জলাশয় কমে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রাণীটি বিলুপ্তির পথে।
‘ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার আব্দুজ জব্বার মিঞা বাড়ির সামনের দিঘির বয়স দুই শ বছরের বেশি। ৫০-৬০ বছর আগেও দিঘির মধ্যে ভেসে থাকা কড়িকাঠ, গাছের ডাল, ঝোপঝাড়, তীর থেকে নেমে আসা গাছের শিকড় ও ঘাটে ছোট-বড় ৫০০-৬০০ কচ্ছপ বসে রোদ পোহাত।
বিপদের গন্ধ পেলে পানিতে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে চলে যেত। ঘাটের সিঁড়িতে বসে আমরা সে মজার দৃশ্য দেখতাম। এখন দিঘিতে একটা কাউট্টাও নেই।’ কথাগুলো বলেন, মিঞা বাড়ির বাসিন্দা, উপজেলার কুতুবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক কবির উদ্দিন চৌধুরী।
কেন নেই, জানতে চাইলে সাবেক এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘বছর বিশেক আগে এ দিঘিতে বাণিজ্যিকভাবে মাছের আবাদ শুরু হয়। সেই থেকে কচ্ছপ, গুইসাপ, সাপ-ব্যাঙ কমতে শুরু করেছে। দু-এক বছর পর পর দিঘি শুকিয়ে জাল দিয়ে জেলেরা পুকুরের সব জলজ প্রাণী ধরে ফেলেন।’
আক্ষেপ করে কবির চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বাস্তব কচ্ছপ দেখেছি, ধরেছি। আমাদের নাতি-নাতনিরা এখন মুঠোফোনে কচ্ছপের কার্টুন দেখে।’
ভোলার বন ও মৎস্য কর্মকর্তা, প্রবীণ জনগোষ্ঠী, জেলে, মৎস্য আড়তদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৎস্য কার্যালয়ের হিসাবে ভোলার প্রায় ৭০ হাজার পুকুর ছিল। আরও ছিল সহস্রাধিক জলাশয়। একটি পুকুরে গড়ে শতাধিক কচ্ছপ থাকলেও ভোলায় ৭০ লাখ কচ্ছপ ও কয়েক লাখ কাছিম ছিল।
বছর দশেক আগেও ভোলার পুকুর-জলাশয়ে এসব কচ্ছপ সাঁতরে বেড়াত। এখন সেই দৃশ্য দেখাই যায় না। পুকুরের কচ্ছপ বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জলাশয়, খাল ও নদীতে বসবাস করা কাছিমও বিলুপ্তির পথে। বিদেশে পাচার, প্রজননের সময় শিকারির হাতে পড়া, পুকুর ভরাট, মাছ চাষ ও কৃষি আবাদ বৃদ্ধি, বন বিভাগসহ প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে বিলুপ্তির পথে কচ্ছপ।
আজ ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। এবারের জীববৈচিত্র্য দিবস ২০২৩–এর প্রতিপাদ্য ‘চুক্তি থেকে অ্যাকশন: জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনুন’। কচ্ছপ ও কাছিম নিধন বন্ধে দিবসটি ভোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভোলা সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মো. কামাল হোসেন বলেন, কুমির ও সাপের মতো কচ্ছপ ও কাছিম ডিম পাড়ার জন্য পানি থেকে ডাঙায় উঠে আসে। প্রথমত, পানি থেকে ডাঙায় ওঠার সময় শিকারির হাতে নিধন হচ্ছে। অন্যদিকে এদের ডিম পাড়ার স্থান কৃষিজমি, পুকুরপাড় মানুষের দখলে চলে গেছে। ফলে প্রাণীটি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ।
২০১২ সালের ১০ জুলাই প্রকাশিত সরকারি প্রজ্ঞাপনে কচ্ছপকে বন্য প্রাণী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২-এর ৬ ও ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, অনুমোদন ছাড়া বন্য প্রাণী শিকার, সংগ্রহ ও আমদানি-রপ্তানি করা যাবে না।
চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, ভোলার পুকুর-জলাশয়ে ও জঙ্গলে বড়শি, কোঁচ, কারেন্ট জাল, খেওজালসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম দিয়ে শিকার করা হচ্ছে কাছিম।
কয়েকজন শিকারি ও মৎস্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুকনো মৌসুমে ফসলের মাঠ, পুকুর, খাল ও কচুরিপানাযুক্ত জলাশয়ে কাছিম ডিম পাড়তে এসে আশ্রয় নেয়। কচ্ছপ প্রজননের সময় পানি থেকে ডাঙায় উঠে আসে। এ সময় শিকারির হাতে বেশি ধরা পড়ছে। তখন পুকুরগুলো মাছ চাষের উপযুক্ত করতে একদম শুকিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করায় কচ্ছপের প্রজননস্থল নষ্ট হচ্ছে।শিকারিরা এসব কাছিম ধরে এক-দেড় হাজার টাকার ওপরে কেজি দরে বিক্রি করেন।
অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব অব ভোলার আহ্বায়ক ও প্রকৃতি সংরক্ষণকারী এস এম বাহাউদ্দিন বলেন, বছর দশেক আগেও ভোলার জলাশয়ে শত শত কচ্ছপ দেখা যেত। এগুলো বিভিন্ন রঙের হতো। লোকেরা একে কাউট্টা নামে ডাকত। এখন সেই কচ্ছপ আর দেখা যাচ্ছে না।
প্রাণিবিশেষজ্ঞ এস এম এ রশীদ বলেন, ভোলার পুকুরে বসবাস করা কচ্ছপের বাংলা নাম কড়ি কাইট্টা (Indian roofed turtle), এটি কচ্ছপের একটি প্রজাতি। বৈজ্ঞানিক নাম পাংসুরা টেকটা (Pangshura tecta)। ভোলায় একসময় প্রচুর পরিমাণে দেখা গেলেও এটি এখন বিলুপ্তির পথে। এর প্রধান কারণ পাচার ও প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া।
ভোলা উপকূলীয় বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, কচ্ছপ শিকার বন্ধে ভোলায় বন বিভাগের একটি টহল দল আছে। সামাজিক সংগঠনের সদস্যরাও নিধন বন্ধে কাজ করছেন। খবর পেলেই তাঁরা সেখানে পৌঁছে যান। তাৎক্ষণিক জব্দ করা কচ্ছপ বা কাছিম নদী-খালে অবমুক্ত করা হচ্ছে।