পুরোনো ছাপাখানার হরফ এল কম্পিউটার ফন্টে

0
240
শুভদীপ রায়

কম্পিউটারে বাংলা লিপির জন্য নতুন ফন্ট এখন প্রায় নিয়মিতই প্রকাশ হয়। তবে দিন কয়েক আগে এই প্রথমবারের মতো পুরোনো ছাপাখানা অর্থাৎ লেটারপ্রেসের হরফের মতো ফন্ট প্রকাশ করেছে দুই বাংলার সম্মিলিত বাংলা ফন্টনির্মাতা লিপিঘর (https://lipighor.com/)। আদ্যিকালের লেটারপ্রেসের সিসার অক্ষরের ছাঁচকে নিয়ে আসা হয়েছে আধুনিকতম প্রযুক্তির জগতে।

শুভ লেটারপ্রেস নামের এই ফন্টের নকশাকার ও প্রোগ্রামারের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ভারতের পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন শুভদীপ রায়। তিনি এই ফন্টের নকশা করেছেন। এটি তাঁর প্রথম ফন্টের কাজ নয়। ২০১৯ সাল থেকে লিপিঘরের একজন সক্রিয় বর্ণশিল্পী ও ফন্ট প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছেন শুভ। এর আগে তাঁর আরও ১২টি বাংলা ফন্ট প্রকাশিত হয়েছে এই ওয়েবসাইট থেকে।

নীলাদ্রি শেখর বালা

শুভ জানান তাঁর বাবার একটি লেটারপ্রেস ছিল। ছোটবেলায় তিনি সেখানে সিসার হরফ দেখেছেন। ফন্ট নিয়ে কাজ করতে শুরু করার পরে তাঁর ইচ্ছা হলো ছাপাখানার হরফকে কম্পিউটারে আনার। বিষয়টি লিপিঘরের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক নীলাদ্রি শেখর বালাকে জানালে তিনিও উৎসাহ দেন।

‘তবে কাজটা সহজ ছিল না কয়েকটা কারণে’, বললেন নীলাদ্রি। ‘প্রথমত আমরা কত পুরোনো বাংলা হরফ ও যুক্তাক্ষরশৈলী নেব—এটা ছিল প্রথম সমস্যা। বেশি পুরোনো নিলে অনেকেই এগুলোকে আর চিনতে পারবেন না।’

পশ্চিমবঙ্গের গড়পারে নিজস্ব প্রেস স্থাপন করার পর উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এরও আগে তিনি হাত পাকিয়েছেন হাফটোন ব্লক তৈরিতে। কাজেই সন্দেশ ছিল নীলাদ্রি-শুভর অন্যতম পছন্দ। কিন্তু দেখা গেল সেখানে অনেক বানান ও অক্ষরশৈলী আছে যা আর এখন একেবারেই প্রচলিত নয়। তখন ঠিক হলো, এর পরের লেটারপ্রেসের নতুন হরফ যাতে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার প্রথম ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রকাশ করেছেন সেটিকে ডিজিটাইজ করা হবে।

ঠাকুরমার ঝুলির ফন্টের ডিজিটাইজ নকশা করতে শুরু করেন শুভ। অন্যদিকে লিপিঘরের কারিগরি টিমকে সামলাতে হয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

প্রথমত সিসার হরফে কম্পোজ করার সময় হরফগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া দেওয়া হতো। এ কারণে দুটি হরফের বা বর্ণের সঙ্গে আকার-ইকারের সংযুক্তি সমানভাবে মিশে যেত না। কিন্তু আধুনিক সমস্ত ডিজিটাল ফন্টেই সেটা আনসি (ANSI) বা  ইউনিকোড (UNICODE) যা–ই হোক না কেন) এগুলোকে সমানভাবে মেশানো হয়। লেটারপ্রেসের এই না মেশা বা ফাঁক থাকা অসমান বৈশিষ্ট্য ডিজিটাল ফন্টে হুবহু তুলে ধরার জন্য অতিরিক্ত প্রোগ্রামিং করে এই বৈশিষ্ট্যকে পরিস্ফুটন করা হয়েছে—জানালেন নীলাদ্রি।

আবার সীসার হরফে কিছু কিছু আকার ই–কার যুক্তবর্ণের আলাদা হরফ ছিল সুবিধার জন্য। যেমন দু, সু, নু ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে মূল বর্ণটি সামান্য বাঁকানো হয়ে থাকে। কিন্তু কম্পিউটার এনকোডিং সিস্টেমে তো এরকম বর্ণযোগের জন্য আলাদা সংরক্ষণ স্পেস নাই। এ সমস্যাও প্রোগ্রামিং করে সমাধান করতে হয়েছে।

তারপর দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে এই ফন্টের পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও সংশোধন করতে হয়েছে। বিশেষ করে যে নমুনাগুলো দেখে নকশা ও প্রোগ্রামিং করা হয়েছে, তার বাইরেও কিছু থাকলে সেটি যেন সংশোধন করা যায়। অবশেষ ১৬ মে শুভ লেটারপ্রেস নামের ফন্টটিকে লিপিঘরে উন্মুক্ত করা হয়েছে।

লিপিঘরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা নিয়ে কাজ করছেন এমন একদল বর্ণশিল্পী ও প্রযুক্তিবিদেরা যুক্ত রয়েছেন। এর উপদেষ্টা বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিদ অমি আজাদ জানান, লিপিঘরে বিক্রির ফন্ট ছাড়াও বিনা মূল্যের ফন্টও রয়েছে। প্রতিটি ফন্টই তিনটি এনকোডিংয়ে জন্য তৈরি করা হয়। যার দুটি সনাতন আনসি কোডিং সিস্টেমের জন্য। আর অন্যটি ইউনিকোডের। এ ছাড়া সেখানে প্রায় সব ধরনের প্রয়োজনীয় বাংলা ফন্টের পাশাপাশি দলিলাদির ফন্ট ও সিস্টেম নিখুঁতভাবে পরিবর্তনের ব্যবস্থাও রাখা আছে।

শুভ লেটারপ্রেস ফন্টটির দাম রাখা হয়েছে ১০০ টাকা। তবে ৮০ শতাংশ ছাড়ে ২০ টাকায় এখন পাওয়া যাচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.