সাদাও ইয়ামামোতোর বয়স তখন ১৩ বছর। তখন জাপানের হিরোশিমা প্রিফেকচার জুনিয়র হাইস্কুলের ছাত্র সে। ইয়ামামোতোর বয়স এখন ৯১ বছর। এই বয়সেও তিনি পরিষ্কার মনে করতে পারেন, কী ঘটেছিল সেদিন সকালে।
দিনটি ছিল ৬ আগস্ট, সাল ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এদিন জাপানের হিরোশিমা শহরে ফেলা হয় আণবিক বোমা। এই হামলার মধ্য দিয়ে বিশ্ব প্রথমবারের মতো আণবিক যুগে প্রবেশ করে। কলঙ্কের অক্ষরে লেখা এই দিনটির জীবন্ত সাক্ষী ইয়ামামোতো। তাঁর অভিজ্ঞতা, জীবনের নানা জটিলতা তিনি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেছেন।
জাপানের হিরোশিমা শহরে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর শীর্ষ সম্মেলন চলছে। গতকাল শুক্রবার এই সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলন উপলক্ষে চালু করা আন্তর্জাতিক মিডিয়া সেন্টারে আজ শনিবার ইয়ামামোতোকে নিয়ে আসে জাপানের একটি সংগঠন। সংগঠনটি বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার উদ্দেশ্যে কাজ করছে।
জাপানে আণবিক বোমা হামলার সরাসরি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের মধ্যে এখনো যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা ‘হিবাকুশা’ প্রজন্ম নামে পরিচিত। এই প্রজন্মের জীবিত সদস্যদের অনেক বয়স হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও তাঁরা এখনো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হামলার ভয়াবহ স্মৃতি পৌঁছে দিচ্ছেন। এভাবে তাঁরা শান্তি আন্দোলনে সক্রিয় থাকছেন। নতুন প্রজন্মকে এই আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করছেন। মূলত এই লক্ষ্যেই ইয়ামামোতোর মিডিয়া সেন্টারে আসা। সেখানে তিনি নিজের কৈশোরের মর্মান্তিক স্মৃতির বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী—
বোমা হামলার আগেই হিরোশিমায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সম্ভাব্য হামলার আগুন থেকে শহরকে বাঁচাতে পুরোনো কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছিল।
গ্রীষ্মের ছুটি উপলক্ষে সে সময় হিরোশিমার অনেক স্কুল বন্ধ ছিল। এ অবস্থাতেও স্কুলের ছাত্রদের এই কাজে লাগানো হয়েছিল। ইয়ামামোতোকেও এই কাজ করতে হয়েছিল।
ইয়ামামোতোর ক্লাসের ছাত্রদের দুই ভাগে ভাগ করে শহরের দুটি জায়গায় পাঠানো হয়েছিল। প্রথম দলটি ছিল আণবিক বোমা হামলার কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি। ফলে এই দলের ১১৩ জন ছাত্র ও ৭ জন শিক্ষকের সবাই হামলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রাণ হারান।
ইয়ামামোতো ছিলেন অপর দলে। তাঁদের পাঠানো হয়েছিল কিছুটা দূরে। ফলে তাঁরা সবাই বেঁচে যান। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী জীবনে নানান স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগতে হয়।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালে ইয়ামামোতো ও তাঁর সহপাঠীরা কাজ শুরু করেন। হঠাৎ তাঁরা আকাশের অনেকটা উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া উড়োজাহাজের শব্দ শুনতে পান। তাঁরা আকাশের দিকে তাকান। দুটি উড়োজাহাজ উড়ে যেতে দেখেন। সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে উড়োজাহাজ দুটি বাঁক নেয়। তারপর নিচের দিকে নেমে আসতে থাকে। একপর্যায়ে আবার ওপরে উঠে যায়। কিছু পরে তাঁরা নিজেদের অবস্থান থেকে পশ্চিম দিকে আগুনের হলকা আকাশ বরাবর উঠতে দেখেন।
ইয়ামামোতোর জন্য পরের কয়েকটি দিন ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। তাঁর বাবা কাজ করতেন হিরোশিমার একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কোম্পানিতে। বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার কেন্দ্রস্থল থেকে কোম্পানিটির কার্যালয় খুব বেশি দূরে ছিল না। তবে সৌভাগ্যবশত ইয়ামামোতোর বাবা বিকেলের দিকে অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসতে সক্ষম হন।
ইয়ামামোতোর বাবার অফিস ভবনটি ছিল পুরু কংক্রিটের দেয়ালে ঘেরা। এ রকম কয়েকটি দেয়ালের আড়ালে থেকে তিনি প্রাণ বাঁচান। তবে পরবর্তী সময়ে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব তাঁকে ভোগায়।
হামলার কেন্দ্রস্থলের কাছাকাছি জায়গায় বসবাস করতেন ইয়ামামোতোর খালা। হামলার দিন থেকে পরিবারটির কারও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন ইয়ামামোতোর মা। হামলার দিন দুয়েক পর ইয়ামামোতোকে তাঁর মা সেখানে পাঠিয়েছিলেন। ইয়ামামোতো সেখানে গিয়ে দেখেন, তখনো এলাকাজুড়ে আগুন জ্বলছে। খালার পরিবারের কারও কোনো অস্তিত্ব নেই। চারদিকে পড়ে আছে লাশ। আর আহত মানুষ করছে আর্তনাদ। এই দৃশ্য ইয়ামামোতোকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।
পরবর্তী সময়ে ইয়ামামোতোর দেওয়া বর্ণনা অনুসরণ করে কয়েকজন শিল্পী কিছু চিত্রকর্ম এঁকেছিলেন। ইয়ামামোতোকে একটি ছবিতে হতবিহ্বল অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ইয়ামামোতোকে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত করেছিল যে বিষয়টি, তা হলো একই ক্লাসের একদল প্রাণোচ্ছল সহপাঠীর হঠাৎ ‘নাই’ হয়ে যাওয়া। তাঁর ভাষ্যে, বস্তুত জীবন শুরু করার আগেই তারা শেষ হয়ে গিয়েছিল।
এ রকম মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে বিশ্বে আর না ঘটে, সেই ব্রত নিয়ে এখনো কাজ করে চলেছেন ইয়ামামোতো। তিনি চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও তাই উদ্বিগ্ন। একে কেন্দ্র করে আরেকটি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর মধ্যে আশঙ্কা কাজ করে।
নিজের বাল্যকালের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণা শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ইয়ামামোতো। ইয়ামামোতোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাঁর প্রজন্মের প্রায় সবাই চলে গেছেন। ফলে ভবিষ্যতে পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে কোনো ভাটা পড়বে কি না।
জবাবে ইয়ামামোতো বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন এই আন্দোলন থামবে না। কারণ, নতুন প্রজন্মও পরমাণুমুক্ত বিশ্ব চায়। তাঁরাও এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এই আন্দোলন প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলবে।